<p>কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত এখন সর্বত্র। সস্তায় ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’-এর জন্য ক্ষুধার্ত কিশোরসমাজের এই অংশ পরিণত হয়েছে সামাজিক ফ্রাংকেনস্টাইনে। এই ফ্রাংকেনস্টাইনকে আবার নিজেদের প্রভাব বিস্তারের ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে সুবিধাবাদীরা। তাতে লাইক-কমেন্টের পাশাপাশি উপার্জনও হচ্ছে কিশোর গ্যাংগুলোর। এর জের ধরে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতাও। দিনশেষে পাড়া-মহল্লার সাধারণ জনতা ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়।</p> <p>খেলার পাতায় সামাজিক থিকথিকে এই ব্যাধি টেনে আনার কারণ আছে। কুখ্যাত কিশোর গ্যাংয়ের মতো ক্রিকেটপাড়ায় শুরু হয়ে গেছে ‘গ্যাং’ সংস্কৃতি! এর আকার বিস্তৃত, পুরো দেশ। কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা আর কতই-বা হবে? এর পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তবে ক্রিকেট গ্যাং সংখ্যায় যেমন আশঙ্কাজনকভাবে বেশি, তেমনি এর পৃষ্ঠপোষকের বিস্তৃতিও সর্বস্তরে। কে নেই এই তালিকায়? বিসিবির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, আমজনতা এবং সংবাদমাধ্যমও আছে।</p> <p>সেদিন একটি ইউটিউব চ্যানেলে একটি কনটেন্ট দেখছিলাম। লিটন দাস কেমন খেলছেন—এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম ছেড়ে বাসায় যাওয়ার পথে নেচেকুঁদে একেকজন দর্শক চ্যানেলটির বুমের সামনে মুখ নিয়ে বলছেন, ‘ভুয়া!’ সেই চ্যানেলের পরামর্শক অতি ঘনিষ্ঠ বিধায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এসব দেখিয়ে কী লাভ?’ বয়োজ্যেষ্ঠর প্রশ্নের উত্তরে নরম সুরে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘মানুষ তো দেখে!’</p> <p>এই এক সমস্যা, মানুষ দেখে। দেখে এসব ‘ভুয়া’ শেয়ার করে, উৎকট হাসাহাসি হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তো, যুক্তি শুনে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এই যারা লিটনকে ভুয়া বলছে, তারা সমাজে কতটুকু কী অবদান রেখেছে, জিজ্ঞাসা করবেন প্লিজ!’ তিনি হেসে চলে যান। নিজের তৈরি কনটেন্টের গ্রাহককে তিনি বিব্রত করবেন না, বুঝতে পারি। দিনশেষে চ্যানেলের কাছে দর্শকের অগ্রাধিকারই বেশি। এই দর্শক শুধু লিটনকেই ‘ভুয়া’ মনে করেন না, তাঁর কাছে সিকান্দার রাজাও ভুয়া। এই দর্শক জানেন না যে একসময় প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে দাঁড়িয়েই রাজার পূর্বসূরিদের খেলা দেখে ক্রিকেট শেখার চেষ্টা করত বাংলাদেশ। এই দর্শক জানেন না, এই জিম্বাবুয়ে কতশত বাধা পেরিয়ে এখন ক্রিকেট খেলে।</p> <p>সমস্যা হলো, এই দর্শক এবং পাঠককে পুঁজি করে চলে সংবাদমাধ্যম। একসময় সাংবাদিকতা ছিল সরেজমিনে দেখে ঘটনাক্রম সাজানো। খেলাধুলার প্রতিবেদন সেই সীমা ডিঙিয়ে খেলোয়াড়ি সামর্থ্যের ওপরও রায় দিত, সেটা প্রতিবেদকের একেবারে নিজস্ব অনুভব থেকে। কিন্তু এখন জমানা বদলেছে। মাঠে চলমান খেলার পাশাপাশি সংবাদকর্মী আড় চোখে ফেসবুকের ‘ভাইভ’ বোঝারও চেষ্টা করেন। কারণ রিপোর্টটা পাবলিক ডিমান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হতে হবে তো! তাই খেলার আগে কিংবা পরে দর্শকের ‘বাইট’ অত্যন্ত জরুরি। সেই প্রতিক্রিয়া যতই ‘ভুয়া’ হোক না কেন!</p> <p>নিজে সংবাদকর্মী বিধায় ক্রিকেট গ্যাংয়ের দায়টা প্রথমে নিজের কাঁধেই নিলাম। এবার এই গ্যাংয়ের আরো পৃষ্ঠপোষকদের প্রসঙ্গে আসা যাক। ক্রিকেটাররা স্বয়ং প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের যুগে সূচনা এই গ্যাংয়ের। শুরুতে ভালোই লাগত। সাকিবিয়ানরা সাকিবের গুণগানে ডুবে, নানা জটিল পরিসংখ্যান দিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাজেও এসেছে। একই ধারায় এগোচ্ছিল তামিমিয়ানরাও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরাও গ্যাং কালচারে ডুবে গেছে! নিজের পছন্দের তারকার গুণকীর্তনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত ‘প্রতিপক্ষ’কে ঘায়েল করায়। সাকিবিয়ানের প্রতিপক্ষ তামিম ইকবাল আর তামিমিয়ানের প্রতিপক্ষ সাকিব। অথচ দুজনই বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। সাকিব-তামিমের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে সাকিব ব্যর্থ হলে তামিমিয়ানরা কেন হিসহিসিয়ে উঠবে? তামিমের ব্যর্থতায় একই প্রতিক্রিয়া হয় সাকিবিয়ান মহলেরও। অথচ সামর্থ্যে-অর্জনে এই দুজনের সমকক্ষ আর কে কবে হবেন, তা অজানা। লিটনকে ভুয়া বলা এই জনতাই একদিন তামিমের বিকল্প ভেবেছিলেন লিটনকে। সেদিন তানজিদ হাসান তামিমের ফিফটির পর লিটনকেই ভুয়া বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন সেই জনতা।</p> <p>আমরা খুব ভালো করে জানি, সময়-সুযোগ বুঝে জনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকরাও। যেমন—সাকিব-তামিমের জন্য বারবারই নিয়মের সঙ্গে আপস করেছে বিসিবি। তাতে পরের স্তরের ক্রিকেটারদের মধ্যেও নিয়ম ভাঙার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাকিব যেমন ক্রিকেটার, সদ্য দলে আসা তরুণও ক্রিকেটার। সময় বদলালে সেই তরুণ একদিন নিয়ম ভাঙবেনই। বোর্ড সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না ক্রিকেট গ্যাংয়ের ভয়ে। এই ভয়ই গ্যাং সংস্কৃতিকে প্রতিপালনের নমুনা।</p> <p>আর ক্রিকেটারদের নিজেদেরও দায় আছে। আপনি সেলিব্রিটি। জনতা গাঁটের টাকা খরচ করে আসে আপনার খেলা দেখতে। মন না ভরলে দু-চার কথা শোনাতেই পারেন। জানি, এটা মানিয়ে নেওয়া কঠিন, তবে চেষ্টা তো করতে হবে। সেই চেষ্টাই নেই। উল্টো টানা তিনবার স্কুপ শট খেলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে আপনি কি নতুন কোন অনুরাগী পেলেন লিটন কুমার দাস? নাকি ক্রিকেট গ্যাংকে আরো তাতিয়ে দিলেন?</p>
