<p>জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত প্রধান আইন ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার’ (আরপিও) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রণীত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। এরপর এখন পর্যন্ত ৪৬ বছরে মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে আইনটি। এ সময়ে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ২১১টি বিষয়। আরপিও প্রথম সংশোধন করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। পরে ১৯৮১, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০০৯, ২০১৩ ও চলতি বছর সংশোধনী আনা হয়েছে। সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সুযোগ রেখে সর্বশেষ আরপিও সংশোধন করা হলো গত ৩১ অক্টোবর। মন্ত্রিসভায় বিষয়টি অনুমোদনের পর সংসদ অধিবেশন না বসায় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংশোধিত আইনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।</p> <p>আরপিওতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকালে ২০০৮-৯ সালে। ২০০৮ সালের ৪২ ও ৪৫ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংশোধন করা হয় আরপিও। ওই বছরই ৫২ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরো একবার সংশোধন করা হয় ৯৫টি অনুচ্ছেদসংবলিত আইনটি।</p> <p>ওই সময় থেকে ভোটার না হয়েও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ইসিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে নিজের সম্পর্কে আট ধরনের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া যুক্ত করা হয় ‘না’ ভোটের বিধান, সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসরের পর তিন বছর এবং বরখাস্ত হলে পাঁচ বছর পার না হলে নির্বাচনে অযোগ্যতার বিধান। দলীয় প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত বিবেচনায় নেওয়া এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিন বছরের বেশি সময় দলের সদস্য থাকাও বাধ্যতামূলক করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় দলে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন এবং দেশের বাইরে কোনো শাখা রাখা। যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটিতে ন্যূনপক্ষে ৩৩ শতাংশ সদস্যপদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আগে কখনো নির্বাচিত না হয়ে থাকলে নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনও বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনে অযোগ্য করা হয় ঋণখেলাপিদের সঙ্গে বিল খেলাপিদেরও। ইসি ওই সময় নির্বাচনী অপরাধের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা লাভ করে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় পুলিশের সঙ্গে আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বাংলাদেশ রাইফেলস (পরে বিজিবি), কোস্ট গার্ড এবং প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি বহাল রাখা হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। ওই সময় থেকে স্টিলের ব্যালট বাক্সের বদলে চালু হয় স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স।</p> <p>নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিওর বাইরে ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের পক্ষে আইন করা হয়। ওই নির্বাচনের পরে ২০০৯ সালে ইসির স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের এবং স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন’। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সংবিধানের ১২৫ (গ) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো মামলায় ইসিকে যুক্তিসংগত নোটিশ বা শুনানির সুযোগ না দিয়ে অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনোরূপ নির্দেশ না দিতে আদালতের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।</p> <p>এদিকে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ওই সব বিধানের মধ্যে ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলো। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে বিলুপ্ত করা হয় দলে তিন বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে সদস্য থাকার বিধানটি। </p> <p><strong>পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কার :</strong>  ইসির তথ্য মতে, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে বিভিন্ন সংশোধনী আনে। ওই সময় নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং অফিসারের কাছে নির্বাচনের আগে প্রার্থীর খরচের সম্ভাব্য উৎস জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা তিন লাখ টাকা, প্রার্থীর ব্যক্তিগত খরচের সীমা পাঁচ হাজার টাকায় সীমিত রাখা এবং প্রার্থী বা তাঁর নির্বাচনী এজেন্টের মাধ্যমে নির্বাচনী খরচের হিসাব প্রার্থীর নাম গেজেটে প্রকাশ হওয়ার আগের নির্ধারিত ৬৫ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিনের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করার বিধান করা হয়। এ ছাড়া নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ইসির আওতায় আনার জন্য ‘নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ-১৯৯০’ জারি করা হয়।</p> <p><strong>এম এ সাঈদের আমল :</strong> অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এম এ সাঈদের নেতৃত্বাধীন ইসি ২০০১ সালের জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে আরপিও সংস্কারের বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছিল। তার মধ্যে কিছু প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি। সরকারের অনুমোদন করা প্রস্তাবগুলো ২০০১ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। ওই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল কর ও টেলিফোন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিল খেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। নির্বাচনে কেউ কারচুপি করলে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তিনটির বেশি আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। নির্বাচনের সময় পুলিশসহ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনে বিঘ্নসৃষ্টিকারীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দিতে হবে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে যেকোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা দিতে হবে ইসিকে। কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিলে ব্যর্থ হলে তাঁকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে।</p> <p>রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইসির প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।</p> <p><strong>কাজী রকিব কমিশনের কর্মকালে সংস্কার :</strong> ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে অনেক প্রস্তাবই সরকারের সমর্থন পায়নি। ওই  অবস্থায় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়সীমা সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা, প্রার্থীর জামানত ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা, রাজনৈতিক দলে ব্যক্তির অনুদানসীমা পাঁচ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা এবং সংস্থার অনুদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চসীমা ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া দলীয় প্রধানদের নির্বাচনী ভ্রমণ প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে না মর্মে বিধান করা হয়েছিল। এর সঙ্গে ‘যুদ্ধাপরাধীর’ পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার ছাড়া কেউ পোলিং এজেন্ট হতে পারবেন না—এসব  বিধান রেখে সংসদে আরপিও সংশোধন বিল পাস করা হয় ২০১৩ সালে।</p> <p><strong>সর্বশেষ নুরুল হুদার কমিশন :</strong> সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির আরপিও সংস্কারের যে তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে সেগুলো হলো ভোট গ্রহণে ব্যালট পেপারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার, কম্পানি বা ফার্মের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা অংশীদারকে সাত দিন আগের পরিবর্তে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ এবং অনলাইনেও প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান। এর জন্য  আরপিওর আটটি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হয়। অবশ্য নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে গত বছর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শেষে গত বছর ২৬ অক্টোবর কে এম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিদ্যমান আইনে বড় কোনো পরিবর্তন আনার দরকার নেই। যে আইন রয়েছে তা-ই যথেষ্ট। আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’</p>