<p>আরবিতে সিয়াম। ফারসিতে রোজা। বাংলায় সংযম। পবিত্র রমজান মাসে এই সিয়াম বা রোজা বা সংযম পালন ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। মুসলমানদের জন্য এটি ফরজ বা অবশ্যপালনীয়। শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই নয়, শুধু খাদ্যাভ্যাসেই নয়, শান্তির ধর্ম ইসলাম এই রমজান মাসে জীবনাচরণ ও চিন্তা-মননের সব কিছুতেই সংযম পালনের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশ মেনে চলে গোটা মুসলিম বিশ্ব। দেশে দেশে মুসলমানরা লাগাম টানে ব্যবসার মুনাফায়, মূল্যে ছাড় দেয় দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টায়, সওয়াবের আশায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম কমে যায়, স্বস্তিতে থাকে ভোক্তা। ছোট-বড় শপিং মলগুলো মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতায় নামে। মূল্যছাড় পেয়ে সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে মনের সুখে কেনাকাটা করে ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। স্বল্প মুনাফায় পণ্য ও সেবা বিক্রি করে ওই সব দেশের ব্যবসায়ীরাও রমজানের খরচ মেটায় বাকি ১১ মাসে করা মুনাফার টাকায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে তার উল্টো। রমজান মাসে যেন সংযমের লাগাম ছিঁড়ে যে যার মতো লেগে পড়ে মুনাফা লোটার প্রতিযোগিতায়। জিনিসপত্রের দাম যায় বেড়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রা ছাড়ায়। মাসিক খরচের খাতা লম্বা হতে হতে চলে যায় নাগালের বাইরে। কোথায় সংযম? কোথায় রোজা? কোথায় সিয়াম? ধর্মের নামে চলে অধর্মের চর্চা।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/May/26-05-2017/jeket/1-1_kalerkantho-2017-5-26.jpg" style="float:left; height:308px; margin-left:12px; margin-right:12px; width:216px" />বছরের পর বছর ধরে এ দেশে রমজান মাস এলেই এসব কারবার দেখে সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী অনেকের মুখেই এমন মন্তব্য শোনা যায়। তাঁরা বলেন, মানুষের বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি বছরজুড়েই নেয় এ দেশের ব্যবসায়ীরা। বাকি ১১ মাসের মোট মুনাফার চেয়েও বেশি মুনাফা করতে চায় সংযমের মাস রমজানে। ফলে রোজা আসা মানেই দেশের মানুষের অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে যাওয়া। রোজায় নির্বিচারে মানুষের পকেট কেটে টাকা হাতিয়ে নেওয়া যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। ইফতারে বেগুনি বিক্রি করা সরু গলির ছোট্ট দোকানদার থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্যের বড় মিল মালিক, যে যতটা পারে দেশবাসীর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় এই রমজান মাসে। এ প্রবণতা কেবল ধর্মীয়ভাবেই নয়, পরিচ্ছন্ন ব্যবসানীতিরও পরিপন্থী বলে মত সাধারণ মানুষেরও।</p> <p>পবিত্র রমজান মাসে খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়, অপরিপক্ব ফল পাকানো হয় রাসায়নিক দিয়ে, চড়া দামের সেই ক্ষতিকর ফল নিয়ে ইফতার সারেন রোজাদাররা। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি হোটেল-রেস্তোরাঁ রোজায় ইফতারি আইটেম বিক্রি করে, সঙ্গে যোগ দেয় কিছু ভাসমান দোকানও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেগুনি নামে বিক্রি করলেও বেসনের ভেতরে বেগুন না দিয়ে কুমড়া কিংবা পেঁপের ফালি ঢুকিয়ে বিক্রি করা হয় উচ্চ দরে। রোজার এক মাস আগে থেকেই ভোক্তাদের ঠকানোর এসব প্রস্তুতি চলে খাদ্যপণ্যের ব্যবসায়ীমহলে। রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধের দায়িত্বে থাকা পুলিশের</p> <p>পকেট ফুলে ওঠে চাঁদার টাকায়। গলির বখাটে থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরাও চাঁদার নামে ‘তোলা’ তোলে যে যতটা পারে। ঈদুল ফিতর যত ঘনাতে থাকে, রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেট আর বিপণিবিতানগুলোর বিক্রেতাদের মুনাফার ক্ষুধা যেন ততই বাড়তে থাকে। কেনা দামের তিন থেকে পাঁচ গুণ দামে বিক্রি করে ঈদের পোশাক, জুতা, কসমেটিকসসহ নানা পণ্য। তাদের অতি মুনাফার লোভের কারণে অনেক দরিদ্র মা-বাবার পক্ষে সম্ভব হয় না আদরের সন্তানকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়া। রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক বেআইনি কাজ প্রতিরোধে আইন থাকলেও বিচার নেই, প্রতিরোধের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হাঁকডাক থাকলেও দমনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।</p> <p>মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্যের মজুদ করাকে ইসলাম ধর্ম অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়।’ হাদিসে এটাও বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি (সংকট তৈরি করে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে, সে অপরাধী।’ ভেজাল মেশানো বন্ধে উম্মতদের সতর্ক করে দিয়ে মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’</p> <p>ইসলামের এসব বাণী জানা থাক বা না থাক, ক্রেতা ঠকিয়ে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে তা মানছে না দেশের ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় পণ্যের বিপুল মজুদ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে রোজার বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয়, বাজারে সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের বেশি দামে ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি, তেলসহ নানা নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য করে। এটি এক ধরনের রুটিনমাফিক কাজে পরিণত হয়েছে তাদের। এ কারণে রোজার দুই মাস আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় ডেকে এনে সভা করতে হয় বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবকে, দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা। ১৫-২০টি বাজার মনিটরিং টিম করা হয় রাজধানীর বাজারদর দেখতে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, র‌্যাব-বিজিবিসহ সরকারের সব দপ্তর তত্পরতা বাড়ায়, কিন্তু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মুনাফায় লাগাম টানা সম্ভব হয় না। প্রতি রোজায় অন্তত দু-তিনটি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বড়, পাইকারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এবার যেমনটি হচ্ছে চিনির ক্ষেত্রে। দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ চিনি মজুদ আছে, আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কম। তবু নানা কৌশলে দর বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ছোলার ক্ষেত্রেও হয়েছে তা-ই। রোজার এক মাস আগে থেকেই বাড়ানো হয়েছে ইফতারে আবশ্যক এই পণ্যের দাম। এর আগে কোনো কোনো বছর ভোজ্য তেলের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ানো হয়েছে, কোনো বছর পেঁয়াজের দাম।</p> <p>রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। চিনির আমদানি মূল্য, জাহাজভাড়া, পরিশোধন ব্যয়, ঋণের সুদহার, কম্পানির মুনাফা, পরিবেশক বা পাইকারি ব্যবসায়ীর মুনাফা ও খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফাসহ সব খরচ যোগ করে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন হিসাব করে দেখিয়েছে, প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য হতে পারে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। রোজার আগে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে প্রতি কেজি চিনিতে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৭ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভোক্তাদের পকেট থেকে।</p> <p>সরকারি বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গতকাল ঢাকার বাজারগুলোতে খোলা চিনির দর ছিল ৬৭ থেকে ৭০ টাকা। ঠিক এক মাস আগে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হতো ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়। এই এক মাসে দেশের ভেতরে চিনির দর বাড়ার কোনো কারণ সৃষ্টি হয়নি, আন্তর্জাতিক বাজারে দর উল্টো কমেছে। তা সত্ত্বেও ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।</p> <p>একই অবস্থা রমজানে ইফতারে জনপ্রিয় খাদ্যপণ্য ছোলার দামের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে বলা হয়েছে, আমদানিমূল্য, সব খরচ ও মুনাফাসহ মানভেদে প্রতি কেজি ছোলার সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য হওয়া উচিত ৭৫ থেকে ৯০ টাকা। রমজান এখনো আসেনি, তার আগেই ছোলার দাম পৌঁছে গেছে ১০০ টাকার ওপরে। টিসিবির বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাজধানীর বাজারগুলোতে মানভেদে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়। সংস্থাটির হিসাবেই এক সপ্তাহ আগে এর দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। আর এক মাস আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।</p> <p>এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে এক দিন ডলারের দাম চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে যায়। আর ওই দিনই চিনি, ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় মিল মালিকরা। অথচ বাজারে তখন বা এখন যেসব তেল ও চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে তার সবই আরো অনেক আগে কম দামের ডলারের সময় আমদানি করা। এমনকি রমজান মাসে যেসব তেল ও চিনি বাজারে ছাড়বে মিল মালিকরা, সেগুলোও এপ্রিল মাসের আগে আমদানি করা। তা সত্ত্বেও এক দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে তেল-চিনির দাম বাড়িয়ে দেয় তারা। দুই বছর ধরে ব্যাংকঋণের সুদহার কমলেও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে এখনো ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের বুলি ছাড়ে।</p> <p>গত ৯ মে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্যসংক্রান্ত এক বৈঠকের কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে তেল-চিনির দর বাড়ার পেছনে ডলারের দরবৃদ্ধি, ব্যাংকের ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও আমদানি শুল্ক বাড়ার কথা বলেছে মিল মালিকরা। ওই বৈঠকে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘অতীতে দেখা গেছে, আমদানি বেশি হলেও মিলগুলো উৎপাদন না করায় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেলেও বাজার অস্থিতিশীল ছিল। ব্যবসায়ীরা তাদের কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) ঠিক রাখলে চিনি-তেলের দাম প্রত্যাশিত পর্যায়ে থাকবে।’</p> <p>ভোক্তাদের জিম্মি করে বিভিন্ন দাবি আদায়ের মোক্ষম সুযোগ হিসেবেও ব্যবসায়ীরা রমজান মাসকে বেছে নেয়। সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের অবস্থা খারাপ বলে বাস মালিকরা ঘোষণা দেয়, রাস্তা ঠিক করা না হলে ঈদে বাস চালাবে না তারা। এবার গরুর মাংস বিক্রেতারা হুংকার ছাড়ল, তাদের দাবি মানা না হলে ১ রমজান থেকে ধর্মঘট ডাকবে তারা।</p> <p>বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও স্বীকার করেছেন, রমজানে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের দামে ‘এদিক-ওদিক’ করেন। চিনিসহ সব পণ্যেরই পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাই চিনি বা অন্য কোনো পণ্যের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে ব্যবসায়ীদের পুরস্কৃত করা হবে জানিয়ে সুফল না পাওয়া মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, কেউ কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p>বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা ব্যক্তিগত কাজে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু রোজা বা অন্য কোনো উৎসবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের জিম্মি করার ঘটনা অন্য দেশে দেখেননি বলে জানিয়েছেন। এমনকি মুসলিমপ্রধান নয়, এমন দেশের ব্যবসায়ীরাও রোজায় পণ্যের দাম বাড়ায়—এমন নজির নেই। গত মঙ্গলবার তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি একবার রমজানে সিঙ্গাপুরের মসজিদে ইফতার করেছেন। অমুসলিমপ্রধান এই দেশটিতে রোজায় জিনিসপত্রের দাম বাড়েও না, কমেও না।</p> <p>কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, রোজায় বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আর সেই সুযোগে অতি মুনাফায় ডুবে যায় ব্যবসায়ীরা। এটা আসলে অসুস্থ একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে শুরু করলে কেউ আর এমন সাহস পাবে না বলে মনে করেন তিনি।</p> <p>জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমান বলেন, রমজান মাস শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সব ধর্মের মানুষের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। সে জন্য বিশ্বের সব দেশে রমজানে ব্যবসায়ীরা কম মুনাফা করে, সম্ভব হলে কিছুটা ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করে।</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা উল্টো, এটা কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। কেউ যদি পরিকল্পিতভাবে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ায়, তাহলে তাকে আল্লাহ্র লানত বা অভিশাপ ভোগ করতে হবে।’</p> <p>বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে রমজানে সরকার জিনিসপত্রের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করে দেয়, ব্যবসায়ীরাও স্বেচ্ছায় দাম কমিয়ে দেয়। বিবিসির সংবাদ অনুযায়ী, গত বছর রমজানের আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন পণ্যের দাম কমিয়েছে। কাতার সরকার রমজান উপলক্ষে গত রবিবার দেশটিতে ৪১৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিয়েছে। এই তালিকায় চাল, ময়দা, দুধ, দই, মাংস, সাবান, আচার, শুকনো ফল, হিমায়িত পণ্য রয়েছে। আর এ তালিকার বাইরে আরো এক হাজার চার শরও বেশি পণ্য রয়েছে, যেগুলো ন্যায্য দামে বিক্রি করতে বিক্রেতাদের আহ্বান জানিয়েছে দেশটির সরকার। রমজান উপলক্ষে কাতারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আল মিরা কনজ্যুমার গুডস কম্পানি তাদের দেশজুড়ে থাকা ৩৫টি শাখার মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে এক হাজার ৪৩৮টি ভোগ্য পণ্য বিক্রি শুরু করেছে। পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরাও রোজায় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বীপ্রধান ভারতের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রোজায় পণ্যমূল্যে ছাড় দিচ্ছে।</p> <p>বাংলাদেশে শুধু নিত্যপণ্যেই জিম্মি করা হয় না দেশের মানুষকে; ঈদকেন্দ্রিক জামা-কাপড়, জুতাসহ কসমেটিকস পণ্যেও ক্রেতাদের গলা কাটে ব্যবসায়ীরা। গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে দেখেছেন, বিক্রেতারা যে মূল্যে জামা, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গাসহ রেডিমেড পোশাক বিক্রি করছে, তাদের কেনা দাম তার তিন ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ১০০ টাকা দিয়ে কেনা একটি ড্রেস তারা ৩০০ টাকায় বিক্রি করছে। এই অভিযোগে গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এবারও যাতে একইভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা বন্ধ করতে না পারে, সে জন্য আগেভাগেই সংবাদ সম্মেলন করেছে সেখানকার ব্যবসায়ীরা।</p> <p>গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রামের একটি বিপণিবিতানে ‘সারারা লেহেঙ্গা’ নামের একটি দোকানে অভিযান চালান জেলা প্রশাসন পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত। সেখানে একটি লেহেঙ্গা বিক্রি হচ্ছিল ১৯ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ দোকানদার ওই লেহেঙ্গাটি কিনেছেন ছয় হাজার ৯৯৫ টাকায়। একটিমাত্র পোশাকেই দোকান মালিকের লাভ ১২ হাজার ৫০৫ টাকা। চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ের মিমি সুপারমার্কেটের ‘ইয়াং লেডি’ নামের একটি দোকানে ১৪ হাজার ৫০০ টাকায় একটি ড্রেস বিক্রি হচ্ছিল, যা দোকানদার মোহাম্মদ নুরুচ্ছাফা কিনেছেন চার হাজার ৫৫০ টাকায়।</p> <p>ঢাকায় পাঞ্জাবির সবচেয়ে বড় দুই মার্কেট সদরঘাটের শরিফ মার্কেট ও মৌচাকে আয়শা শপিং কমপ্লেক্সের বিক্রেতারা জানায়, সারা বছর পাঞ্জাবির তেমন কোনো ক্রেতা থাকে না। তাদের ব্যবসা বছরের একটি মাসে, আর তা হলো রমজান। ১১ মাসে যে পরিমাণ পাঞ্জাবি বিক্রি হয়, তার কয়েক গুণ বিক্রি হয় রমজানে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে শরিফ মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, ‘সারা বছরের দোকানভাড়া, বাড়িভাড়া, সংসারের খরচ ও কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করে বাড়তি মুনাফা করতে রমজান মাসের অপেক্ষায় থাকি আমরা।’</p> <p>দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ী দাম বাড়ায়, তা বলা ঠিক হবে না। গুটিকয়েক লোক এই কাজ করে। রমজানে চাহিদা বাড়ায় কিছু পণ্যের দাম সামান্য বাড়তে পারে। তবে কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।</p> <p>ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যখন বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়, তখন তারা আঙুল ঘুরিয়ে দেখায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তারা বলে, পথেঘাটে পুলিশকে চাঁদা দিতে দিতে হয়রান তারা। পুলিশ চাঁদাবাজি বন্ধ করলে সব কিছুর দামই কমে যাবে। রোজায় যখন ইসলাম ধর্ম সংযম পালন করতে বলেছে, তখন ঈদের বাড়তি খরচ জোগাড় করতে ট্রাক দেখলেই হাত উঁচিয়ে থামানোর পর টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।</p> <p>গত ৯ মে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘চাঁদাবাজি রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। ফেরিতে কাঁচামালের ট্রাক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার না করলে পচে যায়।’</p> <p>গত মঙ্গলবার রাতে বিক্রমপুর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে আলুভর্তি ট্রাক নিয়ে আসেন নোমান। রাস্তায় কত চাঁদা দিতে হয়েছে—এমন প্রশ্নে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বিক্রমপুর থেকে ট্রাক নিয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আসতে পুলিশকে মোট ১৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জ এলাকায় একবার, বাবুবাজার ব্রিজে একবার, তাঁতীবাজারে আরেকবার চাঁদা দিতে হয়েছে। রাস্তায় পণ্যবাহী যানে এভাবে চাঁদাবাজি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যার প্রভাব চূড়ান্তভাবে ভোক্তার ঘাড়েই পড়ে।</p> <p>রমজানে যাতে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি না করে, সে জন্য ব্যবসায়ী নেতা, মন্ত্রী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিবছরই দফায় দফায় বৈঠক করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে শোনা যায়। কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না। বরং নানা কৌশলে তা আরো বাড়ে বছর বছর। গত মঙ্গলবারও বৈঠক শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক বলেছেন, রমজান ও ঈদে পুলিশ চাঁদাবাজি করবে না। কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ ইচ্ছা করলেই কোনো গাড়ি যেখানে-সেখানে থামাতে পারবে না বলেও জানান তিনি।</p> <p>চাঁদাবাজি বন্ধের দায়িত্ব যাদের, তারা নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানালেও ফুটপাতের দোকান, রাস্তার যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p>