<p>সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্পসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার ক্রমেই বাড়ছে। তাঁত ও তাঁতশিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশে যাওয়ার পর দূষিত সেই পানি নলকূপের মাধ্যমে তুলে পান করছে এলাকাবাসী। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি এই দূষিত পানি পানের কারণেই মাতৃগর্ভে অটিস্টিক শিশু জন্ম নিচ্ছে। এক দশক ধরে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।</p> <p>তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত জনপদ সিরাজগঞ্জ। তাঁতশিল্পের জন্য ব্যবহৃত সুতা রঙের বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানি এলাকার জলাশয়গুলোতে ফেলা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই বর্জ্য ফেলার কারণে জলাশয় ভরে যাওয়ার পর বর্তমানে কারখানা মালিকরা পাইপ দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। এসব এলাকার নলকূপ চাপলেই এখন দূষিত পানি উঠছে। চিকিৎসকদের মতে, এমন দূষিত পানি পানের কারণেই গর্ভবতী মায়েরা অটিস্টিক শিশু জন্ম দিচ্ছেন।</p> <p>সম্প্রতি ঢাকার একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদল এলাকার বেশ কিছু নলকূপের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করে। একই সঙ্গে সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও রাজশাহী জোনাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় পানিতে মারাত্মক ডিজেল, অক্সিজেন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট, সিসা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক পাওয়া গেছে, যা মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।</p> <p>জেলার বেলকুচি উপজেলার গাড়ামাসি গ্রামের শহিদুল্লাহ খান ও তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, তাদের বাড়ির চারপাশে সুতা রঙের ডাইং ও প্রসেস মিল রয়েছে। এসব মিলের বর্জ্যযুক্ত রঙিন পানি তাঁর বাড়ির চাপকলে উঠে আসছে। এসব পানি পান করার কারণেই তাঁর ছয় বছরের শিশুকন্যা অটিজমের শিকার হয়েছে বলে ধারণা এশা মনির চিকিৎসকের। এ জন্য শহিদুল্লাহ খান ও নাজমা বেগম পরবর্তী সন্তান নিতেও ভয় পাচ্ছেন।</p> <p>উপজেলার রাজাপুর গ্রামের শাহিন রেজা ও তাঁর স্ত্রী সালমা খাতুন জানান, সাত বছর আগে তাঁদের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, যে কি না অটিজমের শিকার। দেশের নামিদামি ডাক্তার দেখিয়েও কোনো ফল হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন, বাড়ির নলকূপের পানি আর পান করা যাবে না। বিষয়টি জানতে পেরে এ বাড়ির পানি সম্প্রতি ঢাকার একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদল পরীক্ষা করে। আর তাতে মারাত্মক ফসফেট, সিসা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক পাওয়া যায়।</p> <p>বেলকুচি পৌরসভার মেয়র বেগম আশানুর বিশ্বাস বলেন, ‘দূষিত পানির কারণে এ এলাকায় অটিস্টিক শিশুজন্মের হার বেড়েই চলেছে। তাই নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। নির্বাচিত হলে এই অটিস্টিক শিশুদের জন্য কাজ করব। সে জন্য পৌরসভার নিজ তহবিল থেকে অটিস্টিক শিশুদের জন্য শিক্ষা ও সেবা কর্নার খুলেছি। তবে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এর প্রসার ঘটানো সম্ভব নয়।’</p> <p>সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, এ এলাকার নলকূপগুলোর পানিতে মারাত্মক ডিজেল, অক্সিজেন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট, সিসা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক রয়েছে।</p> <p>সিরাজগঞ্জ সরকারি শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, যদি কোনো গর্ভবতী মা কিংবা শিশু ডিজেল, অক্সিজেন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট, সিসা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে, তাহলে তাঁর গর্ভের সন্তান অটিস্টিক হতে পারে। আবার ছোট শিশুরাও এ পানি পান করলে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।</p> <p>সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা ফারজানা তাজ জানান, জেলায় প্রায় ৪০ হাজার প্রতিবন্ধীর মধ্যে ২৫ ভাগ শিশুই অটিজমের শিকার।</p> <p>বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম সাইফুর রহমান জানান, তামাই ও সমেশপুর গ্রামে দুটি পানি শোধনাগার যন্ত্র বসিয়ে এলাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এই প্রকল্প আরো বাড়ানো হবে। আর প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের সরকারি ভাতাসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।</p> <p>সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত জানান, ভূগর্ভস্থ পানি পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া জেলা সদর হাসপাতালে অটিজম ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বিভাগ খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।</p>