<p>পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ৮০টি (বৈধ ১২টি) ইটভাটা রয়েছে। এর ওপর এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক চারটি তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এগুলো পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে, যা ওজোনস্তরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।</p> <p><strong>ওজোনস্তর কী?</strong></p> <p>পরিবেশবিদরা জানান, ওজন অক্সিজেনের একটি রূপ। যার রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর একত্রকরণ। ওজোনস্তর সূর্যের আলোকে শোধন করে (ফিল্টার) পৃথিবীর ওপর ফেলে। আলোর মধ্যে থাকা ক্ষতিকর কণা শোষণ করে নেয়। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মানবদেহ তথা প্রাণিজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু ওজোনস্তর এই অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে নেয়। ফলে রশ্মিগুলো প্রাণির দেহে প্রবেশ করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি দেখতে পেয়েছেন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় ওজোনস্তরে ফাটল তৈরি হচ্ছে। তাপমাত্রা না কমানো গেলে পৃথিবীবাসীর জন্য এটা ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। এই কারণে ওজোনস্তর সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর সংরক্ষণ দিবস পালন করে জাতিসংঘ। দিবসটিতে মূলত ওজোনস্তরের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা যেন আর না বাড়ে, সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।</p> <p><strong>অবৈধ ইটভাটা</strong></p> <p>জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে সরকার অনুমোদিত ১২টি ইটভাটা রয়েছে। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে তাঁদের কাছে মোট ৩২টি ইটভাটার হিসাব রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী সদরসহ আট উপজেলায় বৈধ-অবৈধ প্রায় ৮০টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। ভাটার এক শ্রমিকের মতে, এক রাউন্ড ইট তৈরিতে প্রায় ৩০০ টন কাঠ পোড়াতে হয়। এ হিসাব অনুযায়ী, একটি ভাটায় দুই হাজার ৪০০ টন কাঠ পোড়ানো হয় বছরে। ফলে বছরে প্রায় দুই লাখ টন কাঠ পোড়ে ভাটাগুলোতে।</p> <p>স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছর ২৭ মে পটুয়াখালী বন বিভাগের আওতায় (পটুয়াখালী ও বরগুনা) প্রায় ১৬ হাজার গাছ কাটা হয়। একই বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি দুই জেলায় প্রায় সমপরিমাণ গাছ কাটা হয়। অথচ প্রয়োজন অনুযায়ী মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। এর পরির্বতে এ জেলায় রয়েছে মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর ওপর প্রতিবছর দফায় দফায় দরপত্রের মাধ্যমে গাছ কেটে বন বিভাগ সবুজের পরিমাণ আরো কমাচ্ছে। এ ছাড়া দশমিনা, কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী উপজেলার শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের গাছ প্রায়ই চুরি কিংবা প্রভাবশালীরা কেটে নেয়। নতুন করে সেসব জায়গায় আর চারা রোপণ করা হয় না।</p> <p>এ বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার বড় উত্স ইটভাটা। এগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অনেক বিষাক্ত গ্যাস। যা আমাদের চোখ, গলা ও ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ ছাড়া এটি আমাদের আশপাশের পরিবেশ তথা বাসস্থান এবং কৃষির জন্য হুমকি। ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্যও এসব গ্যাস দায়ী। এ কারণে প্রতিবছর বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।’</p> <p><strong>বিদ্যুৎকেন্দ্র</strong></p> <p>কলাপাড়া উপজেলায় তিন ফসলি কৃষিজমি, আবাসিক এলাকা এবং শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলসংলগ্ন নিশানবাড়িয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। পাশের লোন্দা গ্রামে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দেবপুর গ্রামে আরেকটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া চম্পাপুরে একটি কয়লাভিক্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের চিন্তাভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। সবটিই এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন।</p> <p>এ ছাড়া জেলায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে একাধিক কয়লা কারখানা। যানবাহন, রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারের বিষাক্ত গ্যাসও ওজোনস্তরকে হালকা করছে।</p> <p>পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য। কৃষিজমি ও মাছের উত্পাদন অনেক কমে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গড়ে একটি ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৫০০ টন কার্বন গ্যাস নির্গত হয়। যা দুই লাখ ৩০ হাজার যানবাহনের নির্গত কার্বন গ্যাসের সমান। ওই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মিশে ওজোনস্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র এর চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতি করে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এ এলাকায় এসিড বৃষ্টিও হতে পারে।’</p> <p>এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. মো. মাছুমুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওজোনস্তরকে যত সুন্দর এবং সাবলীল রাখতে পারব, পৃথিবী ততটাই নিরাপদ থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনো শিল্পায়ন করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। নিয়ম মেনে কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়লে আমাদের উত্কণ্ঠার কিছু নেই।’</p>