<p>ছয় বছর আগে শুরু হওয়া ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) সংশোধনের প্রক্রিয়া ‘কোনো কারণ ছাড়াই’ আটকে আছে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ফৌজদারি মামলার বিচারকাজে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধান (এডিআর) যোগ করতে ওই সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়। সংশোধনীর খসড়াও তৈরি করা হয়েছিল।</p> <p>সিআরপিসি সংশোধন হলে অনেক ফৌজদারি অপরাধ প্রচলিত আদালতের বাইরেও আপস-মীমাংসার আইনগত বিধান প্রতিষ্ঠিত হতো। এই আপস-মীমাংসার জন্য প্রতি জেলায় ‘মধ্যস্থতাকারী’ নিয়োগ করার বিধান রাখা হয়েছিল খসড়া সংশোধনীতে।</p> <p>সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের আদালতগুলোতে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৬১৮টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে এডিআর যোগ হলে এই মামলার পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসবে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয় আরেকটু উদ্যোগী হলেই এই সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব।</p> <p>ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আইনমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৩ সালের শুরুর দিকে সিআরপিসি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্প্রতি তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংশোধনীর একটি খসড়া প্রস্তুত করেছিল আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ। কিছুদিন পর আমার মেয়াদ শেষ হলে, এটি আর কনটিনিউ করা হয়নি বলে আমি জানি।’</p> <p>সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক দেশে মামলার বিচারকাজে এডিআর বাধ্যতামূলক। এ জন্য সেখানে মামলার পরিমাণ একেবারেই কম। আমি সেই চিন্তা থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এই বিধান করা গেলে ছোটখাটো ফৌজদারি অপরাধ (যেগুলো আপসযোগ্য) আদালতের বইরে নিষ্পত্তি করা যাবে। ফলে আদালতে মামলার চাপ অনেকাংশে কমে আসবে।’ ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এডিআরের বিধান এখন আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।</p> <p>ব্যারিস্টার শফিক বলেন, ‘শুধু এডিআর নয়, ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্বের পেছনে বিচারকাজ ‘মুলতবি’ অন্যতম কারণ। একটি মামলা যাতে দু-একবারের বেশি মুলতবি না করা হয় সে জন্য ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিধান করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সাধারণত বিচার চলাকালে সাক্ষী হাজির না হওয়ার কারণে এসব মুলতবির ঘটনা ঘটে। আদালতে সাক্ষী হাজির না হলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য শাস্তির বিধান করে আইন করার কাজও শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের দিকে। সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।’</p> <p>আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিতে আপস-মীমাংসা করা যাবে এমন প্রায় ৬২টি অপরাধের উল্লেখ ছিল প্রস্তাবিত ওই সংশোধনীতে। তার সঙ্গে আরো প্রায় ২০টি অপরাধকে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে, অবহেলাজনিত মৃত্যু, গুরুতর আঘাতের কারণে মৃত্যু, মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি ও চুরি। ব্যাংক জালিয়াতির মতো অপরাধও আপস-মীমাংসার যোগ্য অপরাধ করা হয়েছে।</p> <p>আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, গুরুতর কোনো অপরাধকে মীমাংসাযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়নি। গুরুতর অপরাধ যেমন হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি বা চাঁদা আদায় এগুলো মীমাংসাযোগ্য অপরাধ নয়, তাই এগুলো প্রস্তাবিত সংশোধনীতে রাখা হয়নি। অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, সেগুলো নিষ্পত্তির জন্যে আপসের ব্যবস্থা করার প্রস্তার রাখা হয়েছিল খসড়ায়। চেক ডিজঅনার করার ক্ষেত্রে এখন মামলা হয়, সেটি যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি ফেরত দিয়ে দেয় তাহলে আর মামলা চালানোর দরকার পড়ে না।</p> <p>প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিটি সরকার তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য কোনো আইন প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি পার্লামেন্টে পাস হয়ে যায়। জনগণের কাজে আসবে এ রকম আইন করতেই যতো অনীহা।’ তিনি বলেন, এখন আদালতগুলোতে মামলার চাপ একেবারেই সীমার বাইরে। একদিকে বিচারকের সংখ্যা কম আবার আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নও সে রকম নয়।’</p> <p>সিঙ্গাপুরে এডিআর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে মামলার পরিমাণ একেবারেই হাতে গোনা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার রফিক বলেন, ‘আমাদের দেশে করলে সমস্যা কোথায়, আমার মাথায় আসে না। ফৌজদারি অপরাধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সিআরপিসি সংশোধনের প্রয়োজন আছে। এটি আইন মন্ত্রণালয় ইচ্ছা করলেই পারে।’</p> <p>আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘মামলাজট কমাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। অনেকটাই মামলাজট কমে আসছে। মামলাজট কমাতে এবং দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, সরকার তা করবে। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের প্রয়োজন হলে সেটিও করা হবে।’</p> <p>আইন মন্ত্রণালয় সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার আগে আইন কমিশন ফৌজদারি কার্যবিধিতে এডিআর যোগ করতে ২০১০ ও ২০১১ সালে দুই দফা সুপারিশ করে। কমিশনের সাবেক সদস্য ড. এম শাহ আলম বলেন, ‘যেসব অপরাধের সাজা কম, যেগুলো আপসে নিষ্পত্তি হলে সমাজে কোনোরূপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, সেগুলো বিচারিক পর্যায়ে এডিআর পদ্ধতির আওতায় আনলে সুফল পাওয়া যাবে। এ জন্য সিআরপিসি সংশোধন করা জরুরি।’</p>