<p>আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নবনির্মিত নিজস্ব ভবন। ভবনটির দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে দেয়ালে খোদিত কবিতার উজ্জ্বল পঙিক্তমালা, ‘সাক্ষী বাংলার রক্তভেজা মাটি/ সাক্ষী আকাশের চন্দ্রতারা/ ভুলি নাই শহীদের কোনো স্মৃতি/ ভুলব না কিছুই আমরা।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি ভোলেনি বাঙালি জাতি। অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতিদিন ভিড় করে স্মৃতির স্মারক দেখতে। তাদের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। তারুণ্যের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও যথাযথ ইতিহাসবোধ ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির স্মারক দেখতে ভিড় করেছে অসংখ্য দর্শনার্থী। তাদের অনেকেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছুটির দিন থাকায় সপরিবারে ভিড় করেছে অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নিয়ে সাজানো গ্যালারিগুলো ঘুরে দেখছে তারা, জানছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। জাদুঘরে ঘুরতে আসা তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাদের মধ্যে তৈরি করেছে দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি অপার ভালোবাসা। শহীদদের রক্তস্নাত এ দেশের জন্য তারা কাজ করতে চায়। মানুষের জন্য কিছু করতে চায়।</p> <p>১২ বছরের সন্তান আদনান শাহরিয়ারকে নিয়ে জাদুঘর ঘুরে দেখছিলেন রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেন। আদনান কথা প্রসঙ্গে বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের গৌরবের প্রতীক। সেই প্রতীকগুলো দেখে গর্ব বোধ করছি, দেশের জন্য মমত্ব বোধ করছি।’</p> <p>ভবনটির দ্বিতীয় তলায় দেয়ালের সঙ্গে টাঙানো একটি যুদ্ধবিমান। নাম ‘হকার হান্টার’। মুক্তিযুদ্ধের সময় হকার হান্টার যুদ্ধবিমানটি পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এ যুদ্ধবিমান দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেশ কিছু ঘাঁটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এটি। হকার হান্টার দেখতে দেখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাফিজ জামান বললেন, ‘তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি, দেশের জন্য তাদের তেমন মায়া নেই। সুযোগ পেলেই তারা বলে, বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তবে আমার মনে হয়, লাখো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ, তা ব্যর্থ হতে পারে না। জাদুঘরে এসে বুঝতে পারি, দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কী ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তরুণদের মধ্যে এ ত্যাগ ও দেশপ্রেম ছড়িয়ে দিতে হবে।’</p> <p>সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠতেই করিডরে দেখা মিলল শিখা চির অম্লানের। চারপাশে পানি আর মাঝখানে শহীদের স্মৃতি নিয়ে জ্বলছে শিখা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত হয়েছে এ শিখা চির অম্লান। শুধু যুদ্ধবিমান নয়, শিখা চির অম্লান নয়, বাঙালির গৌরবের অনন্য সব স্মৃতির সম্ভার দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বীরত্ব।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ইতিহাস তুলে ধরতে অনন্য পরিকল্পনায় সাজানো হয়েছে জাদুঘরের গ্যালারিগুলো। প্রতিটি গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারক। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ নানা ডকুমেন্ট। একই সঙ্গে রয়েছে নানা স্মারক ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তুলে ধরার ব্যবস্থা।</p> <p>জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, মরণপণ যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে জাদুঘরে রয়েছে নানা স্মারক ও নিদর্শন। আলোকচিত্র, চিঠিপত্র, ভিডিও চিত্র, দলিল, অস্ত্র, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পোশাক-আশাকসহ স্মৃতিচিহ্নের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মফিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জাদুঘরে প্রায় ২৫ হাজার নিদর্শন রয়েছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে অন্যান্য স্মৃতি নিদর্শনও। এ ছাড়া রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা। অডিও-ভিডিও ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে নানা নিদর্শন।’ মফিদুল হক জানান, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক দর্শনার্থী ভিড় করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে আসে দেখতে। এ ছাড়া বিশেষ দিনে, ছুটির দিনে দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।</p> <p>প্রায় আড়াই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত এ জাদুঘরে তিনটি বেইসমেন্ট ও পাঁচটি ফ্লোর রয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জের ম্যুরাল। রয়েছে বৃহৎ আকারের চারটি গ্যালারি। সেগুলোর আয়তন সব মিলিয়ে ২১ হাজার বর্গফুট। এতে থরে থরে সাজানো মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিবাহী নিদর্শন।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিগুলোতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান পর্ব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা ধাপে সাজানো হয়েছে নিদর্শনগুলো। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইতিহাসের নানা বাঁকবদলের বীরত্বগাথা।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারি ঘুরে দেখছিলেন, ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলছিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা সাজ্জাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে আমার জন্ম। বাঙালিরা যে বীরের জাতি, দেশের জন্য পূর্বসূরিরা যে রক্ত দিয়েছেন, স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন—মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে তা ভালোভাবে জানতে পারছি। দেশের জন্য অদ্ভুত এক টান অনুভব করছি। বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পারে দেশের স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে।’</p> <p>জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। রবিবার বাদে সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকছে দর্শনার্থীর জন্য।</p> <p> </p>