<p>শুরুতে তেমন পাত্তা না দিলেও মাত্র মাসখানেকের মধ্যেই এক আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া, জানিয়ে তোলপাড় চলছে দেশজুড়ে। ঘরে ঘরে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে। কারো শরীরে জ্বরের লক্ষ্মণ দেখা দিলেই পরিবারের সবাই আঁতকে উঠছে!</p> <p>এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত এই রোগের প্রকোপে নাস্তানাবুদ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চিকিৎসক আর চিকিৎসা শিক্ষার্থীরাও। তারা নিজ নিজ দপ্তর কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও পড়াশোনা ফেলে নেমে এসেছে রাস্তায়; সামাজিক আন্দোলনের আদলে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে। এলাকায় এলাকায় প্রতিদিন চলছে সতর্কতামূলক মাইকিং।</p> <p>স্থানীয় রোগ গবেষকরা খোঁজখবর নিচ্ছেন বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় এই রোগের গতি-প্রকৃতি আর চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের। প্রতিকারের উপায় নিয়ে নতুন কোনো উদ্ভাবন বা আবিষ্কার আছে কি না, সেই খোঁজ নিচ্ছেন গবেষকরা। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মোস্তফা কামাল রউফ নিজ থেকেই ফোন করে কালের কণ্ঠকে জানালেন—‘ভাই, এ তো দেখছি ভয়াবহ ব্যাপার; চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ভিড় তো বেড়েই চলেছে। আপনারা লেখালেখি করে মানুষকে একটু সতর্ক করে দেন। নয়তো এই রোগ আরো ছড়িয়ে পড়বে।’</p> <p>এমন খবর পেয়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে মেডিসিন বহির্বিভাগের সামনে দেখা যায়, জ্বরের সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা আর হাত-পায়ে ও মুখমণ্ডলে লালচে র‌্যাশ ওঠা মানুষের ভিড়। মোহাম্মদপুরের মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছি। বেশি কষ্ট পাচ্ছি শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথায়। বাসার আরো দুজনের জ্বর দেখা দিয়েছে। কেউ বলছিল সিজনাল ভাইরাস, কেউ বলছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া। ভয় লাগছে, তাই হাসপাতালে ছুটে এলাম।’</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এখন চিকুনগুনিয়ার রোগী নিয়েই দিন-রাত পার করছেন। একই অবস্থা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদের। শুধু কি ঢাকায়! ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। বিশেষ করে বাইরে থেকে যারা ঢাকায় আসা-যাওয়া করে তাদের মাধ্যমে এই রোগ ঢাকার বাইরে ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।</p> <p>বরিশালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. হুমায়ুন কবীর জানান, জ্বর নিয়ে যারা আসছে তাদের কারো কারো দেহে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ দেখা যায়। তবে এসব রোগীর বেশির ভাগই জানিয়েছে যে ঢাকা থেকে ঘুরে আসার পর ওই উপসর্গে তারা আক্রান্ত হয়েছে।</p> <p><strong>এবারই ব্যাপক ছড়াছড়ি :</strong> চিকুনগুনিয়া নিয়ে কাজ করা গবেষকরা জানান, ২০০৫ সালে ভারতে এক দফা এ রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিলে বাংলাদেশে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তখন দেশে এর কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রথম রোগী ধরা পড়ে ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে আবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঢাকার দোহারে এর প্রকোপ দেখা দেয়। এমনকি গত বছরও চিকুনগুনিয়ার কিছু কিছু রোগী ছিল। তবে এবারই প্রথম দেশে এমনভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে কষ্টদায়ক এই রোগের।</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি রাজধানীর ৫২টি এলাকায় সার্ভে করে দেখতে পেয়েছে, প্রায় সব এলাকায়ই চিকুনগুনিয়ার কমবেশি সংক্রমণ রয়েছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি এলাকার মধ্যে ২৭টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২১টি এলাকার মধ্যে ১৭টি এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে যেমন মিন্টো রোড ও বেইলি রোডের ভিআইপি এলাকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে মিরপুর বা মোহাম্মদপুরের মতো এলাকা।</p> <p><strong>আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা :</strong> বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ও শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গুর উপসর্গ অনেকটা একই রকম। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর ঘটনা খুবই কম। সাধারণ জ্বরের চিকিৎসাতেই এই রোগ সেরে যায়। তবে আক্রান্তকে বেশ কিছুদিন ভুগতে হয় অত্যন্ত দুর্বলতা নিয়ে।</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অনেক দেশে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত এটিকে গুরুত্বপূর্ণ রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেনি। তবে আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশলমতো কাজ করে চলেছি।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকুনগুনিয়া হচ্ছে টোগা বা আরবো গোত্রের একটি ভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাথাব্যথা, সর্দি, বমি বমি ভাব, হাত-পা ও আঙুলের গিঁটে ব্যথা, ফোসকা পড়া, র‌্যাশ ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে শরীর বেঁকে যেতে পারে। ডেঙ্গুর মতোই এডিস মশা থেকে এই ভাইরাস  মানবদেহে ঢোকে। সাধারণত মশায় কামড়ানোর পাঁচ দিন পর থেকে শরীরে লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে।</p> <p>ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাধারণত চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ দেখা যায় জ্বরের সঙ্গে পায়ের গোড়ালি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা হলে। এ ক্ষেত্রে মাংসপেশিতে তেমন ব্যথা থাকে না। অন্যদিকে ডেঙ্গু হলে জয়েন্টে ব্যথা কম থাকবে আর মাংসপেশিতে ব্যথা বেশি হবে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর র‌্যাশ সাধারণত পেট, বুকসহ সারা শরীরে হয়। আর চিকুনগুনিয়ার র‌্যাশ হয় সাধারণত হাত-পা ও মুখমণ্ডলে।</p> <p><strong>কন্ট্রোল রুমে তথ্য সংগ্রহ শুরু :</strong> স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে তিন সপ্তাহ ধরে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাগত তথ্য সংরক্ষণ শুরু করেছে। গতকাল সোমবার ওই কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে এ পর্যন্ত মোট ২৪৫ জনের তথ্য পাওয়া গেছে, যারা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তবে এ তথ্য ঢাকা বা দেশের সব হাসপাতালের নয়, কেবল যে কটি হাসপাতাল থেকে তথ্য পাঠানো হয়েছে সেগুলোই সংরক্ষণ করা হয়েছে।</p> <p>অন্যদিকে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে জানান, গত ১৫ জুন পর্যন্ত ঢাকায় মোট এক হাজার ৪০০ চিকুনগুনিয়া রোগীর তথ্য তাঁদের কাছে আছে।</p> <p><strong>পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লাভ নেই :</strong> স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেও ভয়ের কিছু নেই। জ্বর কমে গেলেও বেশ কিছুদিন ধরে ব্যথা থাকতে পারে। আর চিকুনগুনিয়া সন্দেহে রোগ শনাক্তকরণে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়ঝাঁপের কোনো দরকার নেই। কারণ দেশে এই রোগ শনাক্তকরণের প্রযুক্তি আছে কেবল আইইডিসিআরে। এ ছাড়া দেশের অন্য কোথাও শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি নেই।</p>