<p>গ্রামজুড়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। অধিকাংশ বাড়ি টিনের তৈরি। কিন্তু গ্রামে ঢুকতেই শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি বিশাল দুটি অট্টালিকা দৃষ্টি কাড়ে সবার। কাছে গিয়ে না দেখলে মনে হবে রাজপ্রাসাদ।</p> <p>কথিত আছে, এই বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। আর তৈরি করতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ১২ বছর। বর্তমানে কেউ বসবাস করে না এই বাড়িতে। শুধু একজন কেয়ারটেকার রয়েছেন দেখাশোনা করার জন্য। বাড়ির মালিক সাখাওয়াত হোসেন টুটুল গত বছর দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। একটি ব্যাংকের ঋণখেলাপির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার মতিঝিল থানার ওই মামলা দায়ের করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টুটুলের একজন নিকটাত্মীয় বলেন, ‘দেড় মাস আগে টুটুল জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে তিনি দেশে রয়েছেন না বিদেশে রয়েছেন তা জানা নেই। তিনি কোনো মোবাইল ফোনও ব্যবহার করছেন না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টুটুল রূপালী ব্যাংক ঢাকার দিলকুশা শাখা থেকে ৯৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।</p> <p>বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের দেউলী সরকারপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে টুটুল। গ্রামের লোকজন জানায়, স্কুলজীবনে মা-বাবার ওপর অভিমান করে বাড়ি ছাড়েন টুটুল। এরপর ঢাকায় বসবাস করেন। সেখানেই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেন এক অবাঙালি নারীকে। এর পর থেকেই</p> <p>তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটি স্কুল, গাজীপুর টাটকা ফুড প্রডাকশন ফ্যাক্টরি, গ্রামের বাড়িতে একটি ইটভাটা এবং একটি কোল্ড স্টোরেজ ছাড়াও শতাধিক বিঘা আবাদি জমি রয়েছে টুটুলের। এ ছাড়া আরো অনেক ব্যবসা রয়েছে তাঁর। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান টুটুল কিভাবে এত সম্পত্তির মালিক হলেন, তা নিয়ে এলাকায় রয়েছে নানা আলোচনা ও রহস্য।</p> <p>বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শিবগঞ্জ উপজেলার নিভৃত গ্রাম দেউলী সরকারপাড়া। মহাস্থান মোকামতলা হয়ে কিছুটা এগিয়ে পাকুরতলা এলাকায় পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে কয়েক কিলোমিটার এবড়োখেবড়ো পথ পেরোলে দৃষ্টিতে আসবে এই প্রাসাদ। এলাকার লোক এটুকুই জানে, বাড়ির মালিক টুটুল সপরিবারে ঢাকায় থাকেন।</p> <p>বাড়ির পুরো সীমানাসহ প্রতিটি অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। দূর থেকে মনে হবে কলকতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। মূল ফটকটি নাটোরের উত্তরা গণভবনের নকশায় নির্মিত। ভেতরে চারতলা ভবনের প্রথম ইউনিট ও দ্বিতীয় ইউনিটের ওপর চৌকোনা চারটি গম্বুজ উত্তরা গণভবনের (একদা রানির প্রসাদ ছিল) মতো। মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়বে শ্বেতপাথরের হংস ফোয়ারার চার ধারে পাথরের শান বাঁধানো পুকুর। বাড়ির প্রথম ইউনিটে বড় দরজা দিয়ে প্রবেশের পর বিরাট হল রুম। দেয়ালের পরতে পরতে নকশা। দ্বিতীয় ইউনিটে প্রবেশের পর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় নজরে আসবে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা)। প্রতিটি ফলকে প্রাচীন ইতিহাসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।</p> <p>দোতলার ঘরগুলো সুপরিসর। এখানে ফাইভ স্টার হোটেলের লাউঞ্জ ও রিসিপশনের মতো ডিজাইন করে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ তলায় গিয়ে মনে হবে, বিদেশি হোটেলগুলোর মতো যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন এখানে করা সম্ভব।</p> <p>কাঠের জানালা-দরোজাসহ প্রতিটি কাজই প্রাচীন নকশায় তৈরি। দামি কাঠ ব্যবহার হয়েছে এসব কাজে। শ্বেতপাথরও আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। প্রতিটি ঘরেই এয়ারকন্ডিশনার আছে।</p> <p>স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২০০৬ সালে হঠাৎ করে টুটুল পৈতৃক টিনের বাড়ির পাশে প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গা নিয়ে শুরু করেন এই বাড়ি নির্মাণের কাজ। শুরুতে প্রতিবেশীরা মনে করেছিল, মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে অবস্থান করার জন্য তিনি এই বাড়ি তৈরি করছেন। কিন্তু দেখা যায়, ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের গাঁথুনি দিয়ে শুরু করা হয় নির্মাণকাজ। পাশাপাশি দুটি ভবন তৈরি করা হয়। নির্মাণ শেষে বাড়ি দুটি ও সীমানাপ্রাচীরে টাইলসের পরিবর্তে শ্বেতপাথর দেওয়া হয়। এমনকি সেপটিক ট্যাংকের ওপরের অংশেও দেওয়া হয়েছে শ্বেতপাথর। নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরাও এলাকার কেউ নয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে নির্মাণকাজ শেষে ২০১৮ সালে বসবাসের উপযোগী হয় বাড়ি দুটি।</p> <p>একটি চারতলা আরেকটি তিনতলা বাড়ির ছাদে রয়েছে চারটি করে গম্বুজ। প্রধান ফটকে রয়েছে চারটি গম্বুজ। দুটি বাড়ি ছাড়াও আলাদা করে রয়েছে আকর্ষণীয় ডিজাইনের রান্নাঘর, দুটি পুকুর, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি করা একটি পার্ক ও ফুলের বাগান।</p> <p>বর্তমানে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে বাড়িটি একনজর দেখার জন্য। কিন্তু বাড়ির মালিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।</p> <p>কেয়ারটেকার জয়ন্ত কুমার জানান, অপরিচিত লোকজনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। এদিকে লোকজনের ভিড় হওয়ার কারণে বাড়ির সামনে গড়ে উঠেছে একটি হোটেলসহ কয়েকটি দোকান। পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন।</p> <p>গত বছর এপ্রিল মাসে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হন সাখাওয়াত টুটুল। তিনি জেলহাজতে থাকার পর থেকে তাঁর বড় ভাই ফজলুল বারি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করছেন। ফজলুল বারি জানান, তিনি আসলে এসব ব্যাপারে কথা বলতে চান না। টুটুল কেন এত টাকা খরচ করে এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন তাও পরিষ্কার নয়। তবে এটা ঠিক যে এই বাড়ির কারণেই তাঁকে জেল খাটতে হচ্ছে।</p> <p>দেউলী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বলেন, ‘টুটুল ভাই এলাকায় খুবই জনপ্রিয় মানুষ। এলাকার মানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ান তিনি।’ কী কারণে এই প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করা হয়েছে এ বিষয়ে তিনিও কিছু বলতে পারেননি।</p>