<p>রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ‘পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটি’ নামে ভুঁইফোড় এক আবাসন কম্পানির প্রতারণায় নিঃস্ব হয়েছে সাত শতাধিক গ্রাহক। বাহারি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পা দিয়ে এখন প্লট বুঝে পাচ্ছে না গ্রাহকরা। ফেরত পাচ্ছে না বহু কষ্টে অর্জিত অর্থও। একই সঙ্গে জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকরা।</p> <p>রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২১ নম্বর সেক্টরের কাছে মাত্র ৯ বিঘা জমি কিনে এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেছে তিন শ বিঘা জমির বিভিন্ন মাপের তিন হাজার কাঠার প্লট। ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ও প্লট বিক্রিতে রাজউকের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও চলছে ‘ট্রাস্ট সিটির’ সব ধরনের কার্যক্রম। শতাধিক মামলা থাকার পরও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে</p> <p>জোরপূর্বক জমি দখল করে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকদের নিঃস্ব করার অপকৌশলে মেতে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারসহ সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজউক কর্মকর্তারা।</p> <p>জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদী ও রঘুরামপুর মৌজায় প্রকল্প দেখানো হয়েছে পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটির। ২০১২ সালে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন শারমিন সুলতানা লিপি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে আছেন মো. মাহবুবুল আলম। ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানটি প্লট বিক্রি শুরু করে ২০১৫ সালে। আর রাজউকের পূর্বাচল সিটির পাশে তুলনামূলক কম দামে প্লট পাওয়ার আশায় এদের ফাঁদে পা দেয় সাধারণ গ্রাহকরা।</p> <p>বাহারি বিজ্ঞাপনে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে কাঠাপ্রতি ১০ লাখ টাকা মূল্যে সাত শতাধিক প্লট বিক্রি করেছে ট্রাস্ট সিটি। এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। গ্রাহকদের দেখানো নকশা অনুযায়ী ট্রাস্ট সিটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বানাতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, খেলার মাঠ, লেক, রাস্তা, হাসপাতাল ও শপিংমল। সে ক্ষেত্রে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ট্রাস্ট সিটির প্রয়োজন তিন শ বিঘার বেশি জমি। কিন্তু প্রকল্প এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের জমি রয়েছে মাত্র ৯ বিঘা। তবে প্রকল্প এলাকায় ৫০ বিঘা জমি কেনার দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় জমির দালাল বেলায়েত হোসেন টিক্কা ভুয়া দাতা দিয়ে সাধারণ কৃষকের বহু জমি ট্রাস্ট সিটির কাছে হস্তান্তর করেছে। এ ছাড়া সাইনবোর্ড টাঙানোর শর্তে কৃষকদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া জমি গত চার বছরে প্লট আকারে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে ট্রাস্ট সিটি। এমনকি ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দখলে রেখে বেশ কিছু জমির প্লটও বিক্রি করেছে। এ ছাড়া ১৩৬ জন কৃষকের এক শ বিঘা জমিতে জোরপূর্বক কম্পানির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।</p> <p>শিমুলিয়া এলাকার মুরাদ হাসান সিপনের ১৩ শতাংশ, রিপন মিয়ার ৩৯, লুত্ফর রহমানের ১৩, সাজিদুর রহমানের ১৩, মাজহারুল ইসলাম রতনের ২৩, হ্যাপি আক্তারের ১৫, লিলি আক্তারের ১৫, মমতাজ বেগমের ১৫, শফিকুর রহমানের ১৭, বোরহানের ২১ ও কাউসারের ১৪ শতাংশ জমিতে জোরপূর্বক বালু ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>এ ছাড়া স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কুলিয়াদী মৌজার কুলিয়াদী এলাকার নাসির মিয়ার ২৭ শতাংশ, হাশেম মিয়ার ২৩, আমজাদ হোসেনের ১০০, আনোয়ার হোসেনের ১০০, নান্নু মিয়ার ১০০, ওহাব ভুঁইয়ার ১০০, মোজাম্মেল ভুঁইয়ার ২৬, আজিজুল হকের ১৩, মোস্তফা মিয়ার ২৯, ছালাম মিয়ার ৪৪, হাসমত আলীর ৪৫, শিমুলিয়ার হামিদ মিয়ার ১১, রঘুরামপুর মৌজার রঘুরামপুর এলাকার ঈমান খানের ২২, ফজলুল হক খানের ১২, মোফাজ্জাল হোসেনের ২৬ ও হারুনুর রশিদের ২৬ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>এ ব্যাপারে কুলিয়াদী এলাকার মহিউদ্দিন, নুরজাহান, নুর আক্তার, নুরুজ্জামান, রঘুরামপুরের ঈমান আলী, শিমুলিয়ার মাজহারুল ইসলাম রতন, কামাল, কাউসার, মুরাদ হাসান সিপন, সফিকুর, রিপন, বোরহান, সানোয়ার, চোরাকাতলার ফজলুল হক ও রঘুরামপুর এলাকার আরমান মিয়া রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর ট্রাস্ট সিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আর অভিযোগ দায়ের করায় মাজহারুল ইসলাম রতনের বিরুদ্ধে থানায় হয়রানিমূলক মামলা করেছে ট্রাস্ট সিটি কর্তৃপক্ষ। এমনকি তাঁর ভাই মুরাদ হাসান সিপনকে অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের সন্ত্রাসীরা।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাস্ট সিটি প্রকল্পের এসব বেআইনি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মাসিক চুক্তিতে সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের লালন করা হচ্ছে। হিরনাল এলাকার তারা মিয়ার ছেলে হুমায়ুন কবীর মিঠু ও তার সহযোগী কামরুল হাসান নয়ন, মোতাহার ফকির, হালিম মোল্লা, জামান, রেজু, শিবজন, বাবুল, ছলু, রুবেলসহ অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী পেশিশক্তি আর অস্ত্রের জোরে এলাকায় ট্রাস্ট সিটির স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ করছে। সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় গেলে গ্রাহকদের পাশেই দাঁড়ানো থাকে এসব সন্ত্রাসী। স্থানীয় কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাইনবোর্ড টাঙানোর কাজও ওরাই করে।</p> <p>ট্রাস্ট সিটি থেকে জমি কিনে প্লট না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে শতাধিক গ্রাহক। স্থানীয় ১৩৬ জন জমির মালিকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাস্ট সিটির প্রকল্পে ন্যূনতম জমি না কিনে এবং রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে সংস্থাটির বিজ্ঞাপন প্রচার, জমি দখল, বালু ভরাটসহ প্লট বিক্রির ওপর ২০১৭ সালের ১২ জুলাই নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাজউক। রাজউকের সচিব সুশান্ত চাকমা স্বাক্ষরিত ওই নিষেধাজ্ঞার অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) পাঠানো হয়। কিন্তু রাজউকের এই নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এলাকার মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের সহায়তায় সব কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>এ ব্যাপারে ট্রাস্ট সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘একটি বড় প্রকল্প তৈরি করতে গেলে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকবেই। সঠিক হিসাব দেখাতে না পারলেও এলাকায় বহু জমি আমরা কিনেছি। সাত শতাধিক প্লটও বিক্রি হয়েছে। ২৫ জনের কাছে প্লট হস্তান্তরও করা হয়েছে।’ এলাকার লোকজন ভালো নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের বদনাম ও আমাদের হয়রানি করার জন্য তারা অপপ্রচার ও মিথ্যা অভিযোগ করছে।’</p> <p>প্রকল্প এলাকায় মাস্তান পোষা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একটি বড় প্রজেক্ট দাঁড় করাতে গেলে কিছু লোক পালতে হয়। আর ওরা সন্ত্রাসী নয়, আমার স্টাফ।’</p> <p>রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। তাই গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ রইল ওদের বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য। দ্রুতই ওদের সাইনবোর্ড অপসারণ করা হবে।’</p> <p> </p>