<p>পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ—শিল্প মন্ত্রণালয়ের এমন বক্তব্যের সত্যতা পায়নি খোদ নিজ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল হককে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটি তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, আগুনের সূত্রপাত কেমিক্যাল থেকে। তদন্ত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর করা ১৭ দফা সুপারিশ মূল্যায়ন করে নতুন সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়েছে।</p> <p>অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ব্রিফিংকালে বলেন, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। কেমিক্যালের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।</p> <p>পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডস্থল সরেজমিনে ঘুরে ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। তাতেও মন্ত্রীর বক্তব্যের পুনরাবৃক্তি করে বলা হয়, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের সূত্রপাত হয় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। এর সঙ্গে তারা বাড়তি যুক্ত করে, আগুন লাগার পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কেমিক্যালের কারণে। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারও আগুন দ্রুত ছড়ানোর একটি কারণ। ঘটনাস্থলের খুব কাছে প্রসাধনীর বোতলের মধ্যে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।</p> <p>শিল্পসচিব আবদুল হালিম পরদিন শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আগুন লাগার সংবাদ পাওয়ার পরপরই আমরা শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। ওই সময় আশপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করে তাত্ক্ষণিক আমরা জানতে পারি যে সিলিন্ডারের কারণে আগুন লেগেছে। কেমিক্যালের বিষয়টি জানতে পারিনি।’</p> <p>শিল্পমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে সংবাদ সম্মেলন করে শিল্পসচিব বলেন, মানুষের কাছ থেকে শুনে এ কথা বলা হয়েছে; তা সঠিক নাও হতে পারে। পুরোপুরি তদন্ত শেষেই বিষয়টি জানা যাবে।</p> <p>এভাবে মন্ত্রীসহ শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সময় স্ববিরোধী বক্তব্য দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তারা স্বীকার করেছে যে মূলত কেমিক্যাল থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে।</p> <p>অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের নির্দেশে ১২ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যসচিব করা হয় বিসিকের পরিচালক (প্রকল্প) মো. আব্দুল মান্নানকে। কমিটি আজ মঙ্গলবার প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের কপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে শিল্পসংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ভবনের মধ্যে প্রসাধনীর কৌটায় থাকা রাসায়নিকে বিক্রিয়ার ফলে আগুন লাগে। একসঙ্গে অনেক প্রসাধনীর কৌটা থাকায় একটি কৌটা থেকে অন্যটিতে আগুন লাগতে থাকে। আগুন লেগে প্রসাধনীর কৌটা একের পর এক ব্লাস্ট হয়ে আগুন দ্রুত ছড়াতে থাকে, যা তাত্ক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।   </p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিন তদন্তে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে পুরান ঢাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী কেমিক্যাল আমদানি করে বাড়ি, বাসা বা গ্যারেজে গচ্ছিত রেখে ব্যবসা করছে। এখানে কেমিক্যাল উৎপাদনকারী নেই। শিল্পনীতি-২০১৬ অনুসারে এগুলোকে কেমিক্যালের কারখানা নয়, গুদাম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এসব গুদাম থেকে যেকোনো সময় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। এসব গুদাম অতি দ্রুত স্থানান্তর করা প্রয়োজন। যথাযথ অনুমতি নিয়ে এসব ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে না। অনুমোদনহীন এসব গুদাম সরাতে অভিযান চালাতে হবে।</p> <p>নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় সরাসরি কেমিক্যাল আমদানি করে মজুদ রেখে বিক্রি করা হয়। আবার কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনও মজুদ করে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। যেকোনো সময় এসবে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তদন্তে এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে।’</p> <p>তদন্ত কমিটির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে করা ১৭ দফা সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে এবারের সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে।’</p> <p>প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন মেনে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া কেমিক্যাল মজুদ, আমদানি ও বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রদানে নজরদারি বৃদ্ধি, জনবসতিতে কেমিক্যালের মজুদ বন্ধে জনমত তৈরি, বাড়িঘরে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার পরীক্ষার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।</p> <p>জানা গেছে, চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে একাধিক কমিটি কাজ করছে। সব কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা হওয়ার পর ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সমন্বিতভাবে চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হবে।</p> <p> </p>