<p>সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁর জীবন, আইন পেশা চর্চা এবং বিদেশ যাত্রা ও পদত্যাগ নিয়ে একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করেছেন। ‘এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক বইটি গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়। পাওয়া যাচ্ছে ওয়াশিংটনভিত্তিক অনলাইন শপিং কম্পানি আমাজনে। ইংরেজিতে লেখা ৬১০ পৃষ্ঠার বইটিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি তাঁর পদত্যাগের সময় এবং এর আগের কয়েকটি মাসের ঘটনাবলি সবিস্তারে বলেছেন। বিষয়গুলো এসেছে বইটির সারসংক্ষেপেও, যার শেষ অংশে বলা হয়,  পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের হুমকি দেওয়া শুরু হলে বিদেশ থেকে তিনি পদত্যাগপত্র দিতে বাধ্য হন।’ তিনি আরো লিখেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার পর তাঁকে পদত্যাগ ও নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে সরকার। সারসংক্ষেপের অনুবাদ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :</p> <p>‘বিচার বিভাগ একটি দেশের আবশ্যিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। উদার গণতান্ত্রিক দেশের পূর্বশর্তই এটি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে গণতন্ত্রকে দেশের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সংবিধানেই বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, স্বাধীন বিচার বিভাগের কথাও। </p> <p>‘১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এই রূপান্তর এবং এ প্রক্রিয়ার বাধাগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই বছর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের নিম্ন আদালত থেকে আমি আইন চর্চা শুরু করি। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের সর্বোচ্চ বিচারিক পদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাই। তবে ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার পর আমাকে পদত্যাগ এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে বর্তমান সরকার। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া ওই রায়কে সাধারণ নাগরিক ও সুধীসমাজের সদস্যরা স্বাগত জানায়। এই রায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আদালতের পর্যবেক্ষণসহ দেওয়া এই রায়ে সরকারের শাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রবণতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ওই রায় ক্ষমতাসীনদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।</p> <p>‘এর পর থেকেই দুর্ভাগ্যজনক ও নজিরবিহীন নানা ঘটনা ঘটতে শুরু করে, যা নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকেই আমার বিরুদ্ধে অন্যায্য আচরণ শুরু হয়েছিল। ওই দিন সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা হাতে নেয়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতিদের পদ থেকে সরানোর ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (এসজেসি) নামে শক্তিশালী একটি কমিটির হাত থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। রায়ের পরপরই সংসদ সদস্যরা তাঁদের গৃহীত সংশোধনীকে বাতিল করে দেওয়ার জন্য বিচারকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ক্ষমতাসীন দল রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সাত সদস্যবিশিষ্ট আপিল বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এর শুনানি করেন। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ওই বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে ওই আপিল বাতিল করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পর্যবেক্ষণসহ ওই রায় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। এই রায় বাতিলের লক্ষ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট আরেকটি প্রস্তাব পাস করে। প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর দলের অন্যান্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমার তীব্র সমালোচনা করেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলেন। আমাকে আমার সরকারি বাসভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। আইনজীবী ও বিচারকদের আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে জানানো হয়, আমি অসুস্থ এবং চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী মন্তব্য করেন যে আমি বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে চেয়েছি। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই। এক বিবৃতি দিয়ে আমি জনগণের কাছে পরিস্থিতি কিছুটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করেছি। আমি বলেছি, আমি অসুস্থ নই, চিরতরে দেশ ছাড়ার ইচ্ছাও আমার নেই। আমি আশা করেছিলাম, আমার শারীরিক অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত অবকাশ মিলিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে আসবে এবং সিববেচনা জাগ্রত হবে; সরকার রায়ের সার্থকতা অনুধাবন করতে পারবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কায়েম হবে, যা কিনা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হয়।”</p> <p>সবশেষে সিনহা লিখেন, তাঁর পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের হুমকি  দেওয়া শুরু হলে শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র দিতে বাধ্য হন।</p> <p><strong>বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার : </strong>এদিকে গতকাল রাতে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এস কে সিনহা দাবি করেছেন, ষোড়শ সংশোধনী যাতে সরকারের পক্ষে যায়, সে জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের চারজন বিচারক এসে আমাকে বললেন যে তাঁরা আমার সঙ্গে বসবেন না। রাষ্ট্রপতি নাকি তাঁদের ডেকে বলেছেন যে আমার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। আমি আকাশ থেকে ভেঙে পড়লাম। আমি প্রধান বিচারপতি, সেদিন আমাদের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হয়েছে দুপুরে, হাসি-ঠাট্টা করলাম। উনার কাছেই যদি এ রকম অভিযোগ থাকে, উনি তো তখনই আমাকে বলতে পারতেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, উনি আমাকে না বলে আমার অধস্তন বিচারকদের বললেন যে আমার সঙ্গে না বসতে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন রাশিয়ার প্রধান বিচারপতি আসবেন দুই দিন পরে। আমাকে বিচারকরা বলেন যে হাইকোর্টের বিচারকরাও আপনার সঙ্গে আসবেন না। আমি তো জাপানে ছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে তাঁরা অর্গানাইজ করে...একটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চাপ প্রয়োগ করে এই পরিস্থিতি তৈরি করে।’</p>