<p>নিখোঁজ ছেলেদের কথা ভেবে, দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মা রমিছা খানম (৭৫) ও বাবা মোশারফ হোসেন (৯০)। পাঁচ দিন ধরে তাঁদের ঠিকমতো ঘুম নেই, খাবার মুখ দিয়ে নামছে না। কান্নাকাটি করছেন আর সবার কাছে জানতে চাচ্ছেন দুই ছেলের খোঁজ। কিন্তু ছেলে শাফিউল আলম ও মনিরুল আলমের সন্ধান কেউ দিতে পারছে না। এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে একই রাতে নিখোঁজ হওয়া আবুল হায়াত, মোশারেফ হোসাইন মায়েজ ও শফিউল্লাহর মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবারই একই দশা। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয় দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। </p> <p>গতকাল রবিবার এই পাঁচ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, এই  নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারো বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না। এমনকি জিডিও নেই। এর পরও কেন তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, ঘটনায় আসল ডিবি নাকি নকল ডিবি জড়িত—এ নিয়ে তারা কূল-কিনারা পাচ্ছে না। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের একজনও পরিবারের কাছে ফেরেনি।</p> <p>পরিবারের লোকজন দাবি করেছে, নিখোঁজ হওয়ার পর তারা সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। পুলিশ এখনো তাদের মামলা নিচ্ছে না, এমনকি জিডিও। এ অবস্থায় চরম বিপদের মধ্যে আছে তারা। কী করবে বুঝতে পারছে না।</p> <p>পরিবারের লোকজন জানায়, পাঁচ দিন ধরে তারা হাসপাতাল, আদালত, ডিবি অফিস, থানা কোথাও খুঁজতে বাদ রাখেনি। তারা প্রায় নিশ্চিত যে ‘আসল গোয়েন্দা পুলিশই তাদের ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কী তাদের অপরাধ, কেনই বা তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলো সেটা জানানো হচ্ছে না।’</p> <p>গতকাল বিকেলে এ প্রসঙ্গে কথা বললে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তারা আমাদের হেফাজতে নেই। ওই পাঁচজনকে আমরা ধরিনি। তবে তারা নিখোঁজ রয়েছে বলে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি।’ পুলিশ তাদের সন্ধানে নেমেছে কি না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গণমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে আমরা তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে আরো গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখা হবে।’</p> <p>ডিবি পরিচয়ে মানুষকে উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা উচিত না। হুটহাট করে গ্রেপ্তার করলে সাধারণ মানুষের মনে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়। যদি অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত দ্রুত সেসব অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। যাতে করে সাধারণ মানুষের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে। আবার ভুয়া ডিবি পুলিশ যদি কাউকে অপহরণ করে তবে অপহৃতদের উদ্ধার করাও তাদের দায়িত্ব।’ </p> <p>‘সারা দিন আদালতে ছিলাম। যদি ভাইদের আদালতে নেওয়া হয়’— এমন চিন্তা করে গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পুরান ঢাকার নিম্ন আদালতে ছিলেন শাফিউল ও মনিরুলের বড় ভাই রাকিবুল আলম। তিনি কাঁপা গলায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাইদের খোঁজে গত পাঁচ দিন ধরে আদালত, হাসপাতাল, মর্গসহ গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার ভাইরা অপরাধী নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। আমরা কৃষক পরিবার। বাবা-মা অনেক কষ্ট করে আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ভাইরা টিউশনি করে লেখাপড়া করেছে। তারা কখনো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তাদের কেন উঠিয়ে নেওয়া হলো বুঝতে পরছি না।’ </p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হজ পালন শেষে ৪০ দিন পর মাকে নিয়ে দেশে ফেরেন রাকিবুল আলম। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান তাঁর দুই ভাই শিক্ষানবিশ আইনজীবী শাফিউল আলম ও বেসরকারি কম্পানিতে চাকরিরত মনিরুল আলম এবং তাঁদের বন্ধু আবুল হায়াত। এ সময় ডিবি পরিচয়ে একদল লোক তাঁদের তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শফিউল্লাহ ও একটি মাদরাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোশারফ হোসাইন মায়েজকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।</p> <p>শাফিউল ও মনিরুলের মা রমিছা খানম বলেন, ‘আমার দুই ছেলে রাজনীতি করে না। যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মেসে দুই ভাই একসঙ্গে থাকত। আমার নিরপরাধ ছেলেদের কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।’ নিখোঁজ মায়াজের বাবা সাইদুল ইসলাম জানান, তাঁর ছেলে ডেমরার একটি মাদরাসার শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে সেখানেই থাকত। ঘটনার দিন সে বাসা থেকে বের হয়ে যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগে শফিউল্লার কাছে যায়। পরে তিনি খবর পান, ডিবির লোকজন শফিউল্লার সঙ্গে তাঁর ছেলেকেও নিয়ে গেছে। এরপর তারা যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেছেন। কিন্তু পুলিশ জিডি নেয়নি। শফিউল্লার ভাই নাছিরউল্লাহ জানান, তাঁর ভাই শফিউল্লাহ ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ভাইয়ের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে পুলিশ কিছুই বলছে না। এই পাঁচজনের আগে সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়া থেকে ১২ শিক্ষার্থীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে চার দিন ধরে তারা নিখোঁজ দাবি করে। পরদিন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে বলে, এক দিন আগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গুজব ছড়ানো ও ভাঙচুরের অভিযোগ আনা  হয়েছে। তারা সবাই জামায়ত-শিবিরের নেতাকর্মী।</p> <p>এর পরপরই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচল উপশহর থেকে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ এখনো অন্ধকারে। ওই তিন যুবককেও ডিবি সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছে। এই তিনজনকে কারা ও কেন খুন করেছে সে রহস্যের কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। জানা গেছে, গত ১৫ দিনের মধ্যে এ নিয়ে ২১ জন রহস্যজনক নিখোঁজ হয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে দুর্বৃত্তরা লোকজনকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করার বেশ কিছু ঘটনাও নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের আতঙ্ক বাড়ছে।</p>