<p>ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে (তহশিলদার) ‘অসীম ক্ষমতা’ দিয়ে ‘ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০১৮’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়া অনুয়ায়ী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে জমি ব্যবহারের প্রকৃতি পরিবর্তন বা শ্রেণি বদল হলে তা আমলে নিয়ে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) নির্ধারণ করবেন। করের এ তালিকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনুমোদন করলে তা জনসাধারণের জন্য প্রকাশ ও প্রচার করা হবে। যদিও প্রচলিত পদ্ধতিতে এ কাজটি করে থাকেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)।</p> <p>ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার জমির শ্রেণিবিন্যাস, তাঁর ধার্যকৃত কর বা এ আইনের অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি আদালতে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে খসড়া আইনে। এতে বলা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করলে এবং এই কাজের জন্য কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করা যাবে না।</p> <p>ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অধিকার পরিত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হরদম ‘ইচ্ছাকৃত’ ভুল করছেন। এসব ভুলের জন্য আদালতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হলে আইনে সরল বিশ্বাসের সংজ্ঞা দিতে হবে। অর্থাৎ কোনটি সরল বিশ্বাস আর কোনটি সরল বিশ্বাস নয়, সেটা বলতে হবে। একই সঙ্গে মামলা করা না গেলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় এসংক্রান্ত কোনো বিধান নেই।</p> <p>খসড়া আইনে সরল বিশ্বাসের বিধান রাখার কারণ জানতে চাইলে ভূমিসচিব মো. আব্দুল জলিল গত ৮ মার্চ তাঁর দপ্তরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে সব আইনেই সরকারি কর্মচারীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এ সুরক্ষা না দেওয়া হলে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। একজন কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ে বসে তৃণমূল পর্যায়ের একটি ফাইল অনুমোদন করছেন। তাঁর পক্ষে ঘটনাস্থলে কী ঘটছে, তা দেখা সম্ভব নয়। তাঁকে কাগজপত্রের ওপরই বিশ্বাস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে।’</p> <p>খসড়া আইনে খাজনা আদায়ের বছর নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলা সালকে ভিত্তি করে খাজনা আদায় করা হয়। অর্থাৎ ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত সময়ের খাজনা আদায় করা হয়। খসড়া আইনে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয় ১৯৭৬ সালের ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ  অনুযায়ী। আদালতের নির্দেশে সামরিক শাসনামলে প্রণীত অধ্যাদেশ আইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। এই বাধ্যবাদকতার জন্য বিভিন্ন অধ্যাদেশের সমন্বয়ে ভূমি উন্নয়ন কর আইনের খসড়া করা হয়েছে। খসড়াটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।</p> <p>ভূমিসচিব বলেন, ‘আমরা আইনের খসড়া করেছি অধ্যাদেশের সঙ্গে মিল রেখে। ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য ও আদায়ের জন্য প্রণীত এ খসড়া আইনের প্রায় সব বিষয়ই বর্তমানে চালু রয়েছে। এমনকি ভূমি উন্নয়নের যে কর বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে, তা-ই খসড়া আইনে বহাল রাখা হয়েছে। তবে পরে করের হার পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রাখা হয়েছে।’</p> <p>খসড়া আইনে বলা হয়েছে, অর্থবছর অনুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হবে। আগের বছরের কর অনাদায়ী থাকলে তা আদায় না করে নতুন কর আদায় করা যাবে না। ভূমি মালিক ইচ্ছা করলে তিন বছরের কর একসঙ্গে দিতে পারবেন। তবে পরে কর বাড়লে তা পরিশোধ করতে হবে। বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর শতকরা ছয় টাকা ২৫ পয়সা হারে সুদসহ আদায় করতে হবে। একাধিক বছরের বকেয়ার ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি সুদসহ আদায় করতে হবে।</p> <p>ভূমির খণ্ডিতকরণ রোধ করার জন্য একটি দাগে ভূমি মালিকের সর্বনিম্ন জমির পরিমাণ ১ শতাংশ উৎসাহিত করা হবে। ভূমি মালিকের জমি ১ শতাংশের কম অর্থাৎ শতাংশের ভগ্নাংশ থাকলে তা পূর্ণ শতাংশ গণ্য করে কর নির্ধারণ করা হবে।</p> <p>করবস্থান, শ্মশান, মসজিদ, ঈদগাহ, সর্বজনীন মন্দির, গির্জা বা সাধারণের প্রার্থনার স্থান ভূমি উন্নয়ন কর থেকে অব্যাহতি পাবে। তবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোত্রীয়, দলীয় ও সাম্প্রদায়িকভিত্তিক উপাসনালয় বা সমাধিক্ষেত্রকে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে। এ ছাড়া দান ও দর্শনীর অর্থে পরিচালিত উপসনালয় বা সমাধিক্ষেত্রের বেলায়ও কর দিতে হবে।</p> <p>খসড়া আইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের জন্য সার্টিফিকেট মামলা বহাল রাখা হয়েছে। ভূমির মালিক স্বপ্রণোদিত হয়ে বকেয়া কর পরিশোধ না করলে তা আদায়ের জন্য ১৯১৩ সালের সরকারি পাওনা আদায় আইন অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলা করতে পারবে। অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এ আইনের আওতায় ভূমি উন্নয়ন কর কখনো তামাদি হবে না বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কর নির্ধারণী তালিকা প্রকাশের পর কোনো ব্যক্তি সংক্ষব্ধ হলে ১৫ দিনের মধ্যে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে নির্ধারিত কোর্ট ফিসহ আবেদন করতে পারবেন। সহকারী কমিশনার আবেদন পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবেন। সহকারী কমিশনারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করতে পারবেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৪৫ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভাগীয় কমিশনারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করা যাবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের আপিল ৩০ দিনের মধ্যে এবং বিভাগীয় কমিশনারের অপিল ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে তাদের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই পরবর্তী কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করা যাবে। ভূমি আপিল বোর্ড ১৮০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করবে।</p> <p>বর্তমানে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির কোনো কর বা খাজনা দিতে হয় না। খসড়া আইনেও এ বিধান বহাল রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অকৃষিজমিকে বাণিজ্যিক, শিল্প এবং আবাসিক ও অন্যান্য এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে প্রতি শতক জমির ওপর নির্ধারিত হারে কর আদায় করার কথা বলা হয়েছে। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমির ভূমি উন্নয়ন করের হার ক-ধাপে ৩০০ টাকা, খ-ধাপে ২৫০ টাকা, গ-ধাপে ২০০ টাকা, ঘ-ধাপে ১০০ টাকা, ঙ-ধাপে ৬০ টাকা এবং চ-ধাপে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিল্পের কাজে ব্যবহৃত জমির ভূমি উন্নয়ন করের হার ক ও খ-ধাপে ১৫০ টাকা, গ-ধাপে ১২৫ টাকা, ঘ-ধাপে ৭৫ টাকা, ঙ-ধাপে ৪০ টাকা এবং চ-ধাপে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির উন্নয়ন কর ক-ধাপে ৬০ টাকা, খ-ধাপে ৫০ টাকা, গ-ধাপে ৪০ টাকা, ঘ-ধাপে ২০ টাকা, ঙ-ধাপে ১৫ টাকা ও চ-ধাপে ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>ক-ধাপে ঢাকা মহানগরের সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) আওতাভুক্ত এলাকা, ভাওয়ালগড় এবং গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকাকে রাখা হয়েছে। চ-ধাপে পৌর এলাকা ঘোষিত হয়নি এমন এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।</p> <p>ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ভূমি উন্নয়ন করের এ হার ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর রয়েছে। তবে আইনটি পাস হলে করের হার পুনর্নির্ধারণ করা হবে।</p> <p>মালিকানার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য জমির অব্যাহত ভোগদখলের প্রমাণপত্র হিসেবে ১০ টাকা দাখিলা আদায়ের বিষয়টি বহাল রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।</p> <p>একজন কর্মকর্তা জানান, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই দাখিলা বাড়ানো উচিত ছিল। এতে সাধারণ মানুষের কাছে জমির মালিকানার প্রমাণপত্র থাকত।</p>