<p>সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আক্রান্ত স্বনামধন্য লেখক, শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি ফোন করে মেয়ে ইয়েশিম ইকবালকে বলেছিলেন, ‘প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। কিন্তু আমি ঠিক আছি।’ এই যে তাঁর ভেঙে না পড়া সেটাই মেয়েকে প্রভাবিত করেছে দারুণভাবে। ইয়েশিম মনে করেন, দেশে হামলার ঘটনাগুলো যাতে আর না ঘটে তার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দরকার। এ জন্য ভেঙে পড়লে হবে না, দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।</p> <p>গত বৃহস্পতিবার সকালে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত আলাপকালে ইয়েশিম তাঁর বাবার অবস্থা, হাসপাতালে তাঁদের আলাপ, হামলার ঘটনা, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বেড়ে ওঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। বলছিলেন, পিএইচডিটা শেষ করেই মন দিয়ে বড়দের জন্য গল্পের বই লিখবেন।</p> <p>ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া ইয়েশিম ছয় বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে দেশে চলে আসেন। ১৭ বছর বয়সে ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। ২০০৯ সালে উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর চার বছর হার্ভার্ড ল্যাবে গবেষণার কাজ করেছেন। এখন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। মনোবিজ্ঞানের পড়াশোনায় মনোযোগী ইয়েশিম ঢাকায় গড়েছেন ‘কান পেতে রই’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এখান থেকে হতাশাগ্রস্তরা পান জীবনে বেঁচে থাকার বিপুল উৎসাহ।</p> <p>গত ৩ মার্চ ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাটি জানতে পারেন ইয়েশিম। বললেন, “ইনফ্যাক্ট, আব্বু আমাকে নিজেই ফোন করেছেন। আব্বুর ওপর আক্রমণ হলো, যাঁরা ওখানে ছিলেন তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেই গাড়িতে থাকতে থাকতেই আব্বু প্রথমে মাকে ফোন করলেন। মাকে না পেয়ে আমাকে ফোন দিলেন। আব্বু বললেন, ‘আমার ওপর অ্যাটাক করা হয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। কিন্তু আমি ঠিক আছি। খবর এখনই টিভিতে চলে আসবে। দেখে ভয় পেয়ো না। ফ্যামিলির সবাইকে বলে দাও আমি ঠিক আছি’।”</p> <p>ইয়েশিম বলেন, ‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা কেউ ভেঙে পড়িনি, কান্নাকাটি করিনি। কারণ আমরা তো আব্বুর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। আমার সঙ্গে আব্বুর কথা হওয়ার পর আম্মুকে ফোন করলাম। আম্মুকে বললাম, আব্বুর সঙ্গে কথা বলো। আম্মু তখন আব্বুর সঙ্গে কথা বলেছে। তখন এটাই ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে কয়েক ঘণ্টা কনফিউজড ছিলাম।’</p> <p>ইয়েশিম বলছিলেন, তাঁরা সেদিন ঢাকায় ছিলেন। ঘটনা জানার পর সিলেট যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরে তাঁরা জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ড. জাফর ইকবালকে ঢাকায় আনা হবে। তিনি বলছিলেন, ‘সে রাতে ঢাকার সিএমএইচে চলে গেলাম। সিলেট থেকে আব্বুকে ঢাকায় আনতে আনতে অনেক রাত হয়ে গেল।’</p> <p>হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে জাফর ইকবালকে যখন অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে আনা হয় তখনও তিনি কথা বলতে পারছিলেন। ইয়েশিম বলেন, ‘আব্বু বলছিলেন, আমি ফাইন, চিন্তার কিছু নেই। তবে অনেক ব্যান্ডেজ ছিল। দেখে ভীষণ খারাপ লাগল।’</p> <p>এই যে দেশে এ ধরনের হামলা হচ্ছে এবং অনেকে এটা সয়ে নিচ্ছে—সে বিষয়ে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে ইয়েশিম বলেন, ‘এ ধরনের আক্রমণ অবশ্যই প্রচণ্ড দুঃখের ব্যাপার। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে অনেক দিন ধরেই। আব্বুর ওপর যে এটা প্রথম হয়েছে তা নয়। এ ধরনের হামলা উপদ্রবের মতো, অশান্তির। অনেকে মানে, জঙ্গিরা এটা বলে যে, আব্বু ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু আমি বলব, এটা সত্য না। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে একটা লেখাও লেখেননি, কথাও বলেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। এরা (হামলাকারী গোষ্ঠী) হয়তো এটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না।’ তিনি আরো বলছিলেন, “এই ধরনের মানুষগুলো ‘বাংলাদেশ’ না। এরা সমস্যা, সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি দেশে এ ধরনের সমস্যা আছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরা ‘সিরিয়াস প্রবলেম’। আমেরিকার কথা ছেড়েই দিলাম। এ সমস্যা সমাধানে সবাইকে কাজ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে।”</p> <p>এর আগেও জাফর ইকবালের ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল বলে জানান ইয়েশিম। তিনি বলেন, ‘আমার যখন ১২ বছর বয়স তখন সিলেটে টিচার্স কোয়ার্টারে আমাদের বাসায় জামায়াত-শিবির হামলা করেছিল।’</p>