<p>রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বিটাক কার্যালয়ের কাছে গতকাল রবিবার ট্রাকে করে খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি হচ্ছিল। সারিবদ্ধভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ১৫০ টাকায় পাঁচ কেজি আতপ চাল কেনেন রিকশাচালক শফিক। চালের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরতেই প্রতিবেদকের মুখোমুখি হলেন মলিন জামা-লুঙ্গি, মাথায় কালো টুপি পরা খেটে খাওয়া মানুষটি।</p> <p>‘আতপ চালের ভাত খান?’ প্রশ্নের জবাবে ৪৫ বছর বয়সী ওই রিকশাচালক বিরস মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/September/14-09-2017/1/kalerkantho-18-09-2017-15.jpg" style="float:left; height:179px; margin:12px; width:141px" />বললেন, ‘আতপ চাল তো খাই না বাবা। কিন্তু বাজারে চাল ৫০-৫৫ টাকা।’ পাশ থেকে অন্য এক ক্রেতা বলে উঠলেন, ‘৬০ টাকা।’ শফিক বললেন, ‘আমরা তো ওই পর্যন্ত যাইতে পারি না। ৫০-৫৫ টাকাই আমাদের কাছে বেশি। এইখানে ৩০ টাকায় পাইলাম। কয়েক দিন আতপ চাল খাইলে তো কয়টা ট্যাকা বাঁচে।’ কথাগুলো বলে চালের ব্যাগ হাতে নিজের রিকশার দিকে হাঁটা দিলেন শফিক। আতপ চাল দিয়ে এবার শুরু হয়েছে ওএমএস তথা খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গতকাল সারা দেশে এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। তবে আতপ চালের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ কম। গতকাল বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখা গেছে, ওএমএসের আতপ চাল কিনতে ক্রেতার কোনো লাইন নেই। এদিকে ক্রেতাদের পছন্দ না হলেও সরকারকে আতপ চাল দিয়েই ওএমএস চালাতে হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কারণ সরকারের গুদামে যেসব চাল আসছে এর বেশির ভাগই আতপ।</p> <p>খাদ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি বিদেশ থেকে যেসব চাল এনেছে সেগুলোর মধ্যেও আতপই বেশি। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে যে চাল আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাও আতপ।</p> <p>খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আতপ হলেও ওএমএসের চালের মান ভালো। যারা একবার এসব চাল নিচ্ছে তারা পরে সিদ্ধ চাল না কিনে আতপ চালই খুঁজবে। আমরা আতপ দিয়েই ওএমএস চালাব।’</p> <p>মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গতকাল দিনভর বৈঠক করেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। মিয়ানমার দেড় লাখ টন চাল বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। তবে দর এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মিয়ানমার এক লাখ ৩০ হাজার টন আতপ এবং ২০ হাজার টন সিদ্ধ চাল বিক্রি করতে চায়। দেশটির প্রতিনিধিদল প্রতি টন আতপ চালের দাম চাইছে ৪৫০ ডলার। বাংলাদেশ ৪৪০ ডলার দিতে রাজি হয়েছে। আর সিদ্ধ চালের দাম মিয়ানমার চাইছে ৪৮৫ ডলার। বাংলাদেশ চাইছে একটু কমাতে। তবে কমানোর জন্য দর-কষাকষি করলেও মিয়ানমারের চাল হাতছাড়া করতে রাজি নয় বাংলাদেশ। দর চূড়ান্ত না হলে আজ সোমবারও মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠক চলবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।</p> <p>গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে তিন লাখ ৩৯ হাজার টন চাল রয়েছে। এসবের মধ্যে সিদ্ধ চাল থাকলেও তা দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের রেশন দিতে হবে। আর ওএমএস দেওয়া হবে বিদেশ থেকে আমদানি করা চালে। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল দেশে এসেছে। এর মধ্যে দুই লাখ টনই আতপ। এ ছাড়া কম্বোডিয়া থেকে যে আড়াই লাখ টন চাল আসছে সেটাও আতপ।</p> <p>আতপে বিমুখ, তবু কিনছে কেউ কেউ : চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলেও সরকার চালের অভাবে এত দিন ওএমএস শুরু করতে পারেনি। বিদেশ থেকে চাল সংগ্রহ করে গতকাল সেই ওএমএস শুরু হয়েছে। শুরুর দিনে ওএমএস কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা ছিল। ঢাকা মহানগরীতে ওএমএসের ১০৯টি ট্রাক থাকলেও দিনের প্রথমার্ধে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট লোকজন। দুপুরের পর থেকে রাজধানীতে এসব ট্রাক দেখা গেলেও ট্রাকের চালের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল না।</p> <p>খাদ্য অধিদপ্তরের ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক তপন কুমার দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজধানীতে ১০৯টি ট্রাকে এবং দুটি দোকানে ওএমএস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে এসব ট্রাক চাল বিক্রি করবে। তবে প্রথম দিন হিসেবে ওএমএসের এসব ট্রাক সময়মতো স্পটে উপস্থিত হতে পারেনি। আগামীকালের (সোমবার) মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’</p> <p>টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ওএমএসের (ওপেন মার্কেট সেল) চাল বিক্রির খবর জেনে অনেকে বিজয় সরণি, দিলকুশা ও মতিঝিলে কয়েকটি নিয়মিত স্পটে গিয়ে হতাশ হয়েছে। পরে বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে জানা যায়, তেজগাঁওয়ের দুটি স্পটে ওএমএসের চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। সকালে মতিঝিল থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে রওনা করতেই আরামবাগে এসে দেখা মিলল একটি ‘ট্রাক সেল’-এর। তবে কোনো ক্রেতা নেই। চুপচাপ চালের বস্তার ওপর বসে আছেন শাহাবুদ্দিন নামের এক বিক্রয়কর্মী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আতপ চাল হওয়ায় কেউ কিনতে চাচ্ছে না। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র দুই বস্তা চাল বিক্রি হয়েছে।’ শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্যেই ক্রেতাগোছের দু-তিনজন এসে ট্রাকটির সামনে দাঁড়ায়। কেউ কেউ মুঠোখানেক চাল হাতে নিয়ে বলে, ‘চালে তো বাজে কোনো গন্ধ নাই। রান্না করলেই বোঝা যাবে খেতে কেমন।’ তবে রফিকুল ইসলাম নামের একজন বয়স্ক লোক বাদে কেউই চাল কিনতে আগ্রহ দেখাল না।</p> <p>ফকিরাপুলের একটি আবাসিক ভবন দেখভালের কাজ করেন রফিকুল। সেখানেই তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সস্ত্রীক বসবাস করেন তিনি। জানতে চাইলে রফিক বলেন, ‘আতপ চাল খাওনের অভ্যেস নাই। তয় আইছি যহন পাঁচ কেজি চাল নিয়াই যাই।’ অন্য যারা আগ্রহ নিয়ে এসেছিল তারা আতপ চাল আর ট্রাক সেলের ওপর বিষোদ্গার করতে করতে চলে গেল। তাদের অনেকেই অভিযোগ করে বলল, ‘দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ দিচ্ছে আতপ চাল, যা দিয়ে ‘জাউ’ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া যাবে না।’</p> <p>ট্রাক সেলের অন্যান্য স্পটের খোঁজে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে এসে সন্ধান মিলল বিটাকসংলগ্ন ‘ডি ৬’ নম্বরের ট্রাক সেল। পরিবেশক সগির আহমেদের অনুপস্থিতিতে চাল ও আটা বিক্রি করছিলেন নান্নু হাওলাদার নামের এক বিক্রয়কর্মী। সেখানে তিন-চারজন ক্রেতা নান্নুর সঙ্গে বচসা করছিল চাল কিনলে আটাও কিনতে হবে কেন, তা নিয়ে। এ কারণে চাল না কিনে ফিরে যাচ্ছিল কেউ কেউ। প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সুর বদলে যায় নান্নুর। এবার তিনি ক্রেতাদের মধ্যে যারা চাল নেবে তাদের কাছে চাল বিক্রি করতে লাগলেন, যারা আটা নেবে তাদের কাছে আটা। আটা প্রতি কেজি ১৭ টাকা, পাঁচ কেজি ৮৫।</p> <p>এখান থেকে পাঁচ কেজি করে চাল ও আটা কিনে ফিরছিলেন জেসমিন নামের এক গার্মেন্টকর্মী। তিনি বললেন, ‘আমার ডায়াবেটিস আছে, নরম ভাত খাই। তাই আতপ চাল হলেও কিনলাম। এমনিতে বাজারে তো চালের দামও বেশি।’</p> <p>সকাল ১০টায় রাজধানীর আজিমপুর ছাপরা মসজিদের গলিতে গিয়ে দেখা যায় দুটি ট্রাক ওএমএসের চাল নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রতিটি ট্রাকে এক টন করে চাল। এসব ট্রাক ঘিরে কোনো ক্রেতা দেখা যায়নি। প্রায় ২০ মিনিট পর ট্রাক থেকে চাল কিনতে যান লালবাগের মমতাজ বেগম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওএমএসের ট্রাক দেখে চাল কিনতে এসেছি। আমি মনে করেছি, আগেরবারের মতো এবারও ১৫ টাকা কেজি দরেই চাল বিক্রি হবে। চাল নেওয়ার পর যখন টাকা দিয়েছি তখন জানায় চালের কেজি ৩০ টাকা। ওএমএসের চালের দাম বাড়ানোর আগে আরো প্রচার দরকার ছিল।’ মমতাজের পরই ট্রাক থেকে চাল কেনেন মিজানুর রহমান। তিনি জানান, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর থেকে তিনি ওএমএসের চাল কেনার জন্য আজিমপুর গেছেন। কিন্তু আতপ চাল দেখে তিনি হতাশ। এত দূর থেকে গিয়ে খালি হাতে ফেরত যাননি মিজানুর। শেষ পর্যন্ত পাঁচ কেজি আতপ চাল কিনেছেন।</p> <p>আজিমপুর ছাপরা মসজিদ এলাকার ওএমএসের ডিলার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক টন চাল নিয়ে সকাল ১০টায় স্পটে এসেছি। এখন বাজে দুপুর সাড়ে ১২টা। এই সময়ে মাত্র ১০০ কেজি চাল বিক্রি করেছি। আতপ চাল হওয়ার কারণে ক্রেতা নেই। এই চালই যদি আতপ না হয়ে সিদ্ধ হতো তাহলে আড়াই ঘণ্টায় এক টন বিক্রি শেষ হয়ে যেত। এই সময়ে দেখা যেত ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধ চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত। ওএমএস সফল করতে হলে সিদ্ধ চালই লাগবে। আতপ চাল দিয়ে ওএমএস সফল হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। আগে আমরা ১৩ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে চাল কিনে ১৫ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন সেটা ২৮ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে ৩০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।’</p> <p>ফার্মগেটের খামারবাড়ি এলাকায় ওএমএসের স্পট ঘুরে দেখা গেছে, দুটি স্পটেই ক্রেতার সংখ্যা কম। ওএমএস সেন্টারের ডিলাররাও জানিয়েছেন, আতপ চাল হওয়ার কারণেই ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাঁরাও আতপ চালের পরিবর্তে সিদ্ধ চাল দিয়ে ওএমএস পরিচালনার অনুরোধ জানান। তাঁরা সিদ্ধ চালে ওএমএস করা হবে ভেবেই চাল তুলেছেন। আতপ চাল দেওয়া হলে পরে আর ওএমএসের চাল তুলবেন না বলে জানান বিভিন্ন স্পটের ডিলাররা।</p>