<p>টানা বৃষ্টি, উজানের পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানি উপচে এবারের বন্যায় কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১০ জেলায় প্রায় ৬৮ হাজার ২৮০ হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। এসব জমিতে রয়েছে ধান, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। এই নিয়ে হাজারো কৃষক চরম বিপাকে পড়েছে। বন্যার পানি দ্রুত অপসারণ না হলে পরবর্তী ফসল ঘরে তোলা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।</p> <p>কৃষকরা জানিয়েছে, বন্যায় দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে আছে ফসলের জমি। ধানগাছ পচতে শুরু করেছে। নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে ফসলসহ কয়েক শ বিঘা আবাদি জমি। পানি শিগগিরই নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এসব ফসল ঘরে তোলার কোনো আশাও নেই। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির যে পরিমাণ এ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে তা সঠিক নয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি। </p> <p>এদিকে ফসল হারিয়ে কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা নেমে এসেছে। বেশির ভাগ কৃষক এনজিও, ব্যাংক অথবা চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণে টাকা এনে ধানের আবাদ করেছে। এখন বন্যায় ফসলহানিতে তারা দুই চোখে অন্ধকার দেখছে।</p> <p>মাদারীপুরের চরজানাজাত গ্রামের কৃষক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমার ১৮ বিঘা ধান পানিতে তলাইয়া গেছে। আমি এনজিও থিকা ঋণ আইনা ধান লাগাইছিলাম। আমার মতো অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থিকা ঋণ কইরা ধান লাগাইছে। এহন ঋণের টাকা শোধ করমু কেমনে? সরকার যদি আমাগো দিকে না তাকায় তয় মইরা যামু।’</p> <p>তবে বিভিন্ন জেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন,  ভাসমান বীজতলা, আগাম সবজি উৎপাদনের জন্য চারা প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে আর্থিক সহায়তা করা হবে। বিস্তারিত আমাদের আঞ্চলিক অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে :</p> <p>সিলেটে গত চার মাসে দুই দফা বন্যায় কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কৃষকরা কতটুকু ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গত এপ্রিলে ১৩টি উপজেলায় বন্যায় বোরো ফসল হারিয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৫৭০ জন কৃষক। ৮৩ হাজার ৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হলেও অর্ধেকেরও বেশি ফসল পানিতে তলিয়ে যায়।</p> <p>জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ২৬ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি বলে জানিয়েছে কৃষকরা। এ ছাড়া সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে শিলাবৃষ্টিতে প্রায় ৩৫৫ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিবৃষ্টিতে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার শাকসবজি নষ্ট হয়েছে।</p> <p>সিলেটে এবার বন্যায় ফসলহানি হয়েছে ছয় উপজেলায়। উপজেলাগুলো হচ্ছে বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিয়ানীবাজার। এখানে ৮০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় সাত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেকায়দায় পড়েছে পাঁচ হাজার ৩৫০ জন কৃষক।</p> <p>বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় এবারের বন্যায় ৩৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাব মতে, এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এরই মধ্যে জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর দেড় কোটি টাকার কৃষি পুনর্বাসন সহায়তার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।</p> <p>কৃষকরা জানিয়েছে, বন্যায় দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে আছে ফসলের জমি। ধানগাছ পচতে শুরু করেছে। নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে ফসলসহ কয়েক শ বিঘা আবাদি জমি। পানি শিগগিরই নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এসব ফসল ঘরে তোলার কোনো আশাও নেই।</p> <p>বগুড়া জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার জানান, বন্যায় তলিয়ে গেছে পাঁচ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির রোপা আউশ, পাট, আমনের বীজতলা, শাকসবজিসহ নানা জাতের ফসল। এতে ২৪ হাজার কৃষক পরিবার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তলিয়ে যাওয়া ফসলের আর্থিক মূল্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকা।</p> <p>কুড়িগ্রামে বন্যায় পাট, বিভিন্ন ধরনের সবজি, কলা, বীজতলাসহ আরো বেশ কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে ৪৯ হাজার ৩৯২ জন কৃষক। ৯টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নের মোট তিন হাজার ৬২০ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৩০০ হেক্টর জমির পাট, ৩৩০ হেক্টর আউশ ধান, ৪৫০ হেক্টর বীজতলা, ৫৪০ হেক্টর শাকসবজি রয়েছে।</p> <p>ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানিয়েছে, প্রথম দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আমন রোপণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। ফুলবাড়ীর খোচাবাড়ী গ্রামের কৃষক শাহাদাৎ হোসেন জানান, তাঁর দুই একর জমি আবাদের জন্য তৈরি করা বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। কিন্তু বীজ পাওয়া যাচ্ছে না।</p> <p>টাঙ্গাইলের চার হাজার ৪০৮ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। তবে পানি অতিরিক্ত বৃদ্ধি না পেলে এর বেশির ভাগ ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। বন্যাকবলিত এলাকার মোট চার হাজার ৪০৮ হেক্টর ফসলি জমিতে পানি উঠেছে। এর মধ্যে বোনা আমন এক হাজার ৮১৩ হেক্টর, রোপা আমনের বীজতলা ৫৬ হেক্টর, রোপা আমনের আবাদ ৯৮ হেক্টর, পাট এক হাজার ১৯৪ হেক্টর, আউশ ৯৮৭ হেক্টর ও ২৬০ হেক্টর সবজির জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যার পানি একেবারে নেমে না গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে না।</p> <p>মৌলভীবাজারে বোরো ও আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে ১১ হাজার ৬২১ হেক্টরের। এর মধ্যে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯১৪ হেক্টর ও আউশ এক হাজার ৭০৭ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত জমি থেকে চাল উৎপাদন হতো ৩৩ হাজার ৯০৭ মেট্রিক টন। ৩৪ টাকা কেজি দরে এই চালের মূল্য ১১৫ কোটি ২৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।</p> <p>মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চার ইউনিয়নে ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। মাদারীপুর শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত, বন্দলখোলা ও সন্ন্যাসীর চর ইউনিয়নে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া নদীভাননে ফসলি জমিসহ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।</p> <p>শেরপুরের কামারের চরে পানিতে তলিয়ে ৬০০ বিঘা জমির ধান ও পাটের ক্ষতি হয়েছে। গতকাল সদর উপজেলার কামারের চর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, অনেক জমির ধান, পাট ও কিছু তরিতরকারির ক্ষেত বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় কামারের চর ইউনিয়নের প্রায় ৪০০ বিঘা জমির পাট এবং অন্তত ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু সবজির আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানায়, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে ক্ষেতের আবাদি ফসল।</p> <p>লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার ৫৯ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জমিতে ছিল রোপা আমন বীজতলা ও বিভিন্ন শাকসবজি। তবে দ্রুত পানি নেমে যাওয়ায় শুধু হাতীবান্ধা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ২৪ হেক্টর ক্ষেত পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে বেশির ভাগ জমিতেই ছিল বীজতলা। হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, ‘হাতীবান্ধায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৪ হেক্টর জমিতে প্রায় দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’</p> <p>সিরাজগঞ্জে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলায় বন্যাকবলিত ৫০টি ইউনিয়নে এবারের বন্যায় সরকারি হিসাবে ১৩ হাজার ৭৫৬ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষকরা বলছে, ক্ষতির পরিমাণ এর দ্বিগুণ। বন্যায় নষ্ট হয়েছে বীজতলা, পাট, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আখ ও রোপা আমন। ফসল নষ্ট হওয়ায় জেলায় প্রায় এক লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ফসল ও কৃষকের ক্ষতি পূরণে এরই মধ্যে ভাসমান বীজতলা, আগাম সবজি উৎপাদনের জন্য চারা প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে আর্থিক সহায়তা করা হবে বলে জানান জেলা কৃষি কর্মকর্তা।</p> <p>নীলফামারীতে সাম্প্রতিক তিস্তার বন্যায় ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় কৃষিতে ক্ষতির হিসাব সামান্য দেখিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ। বন্যাত্তোর কৃষি বিভাগের নির্ধারণ করা ওই ক্ষতির তথ্য মানতে নারাজ কৃষক ও এলাকার জনপ্রতিনিধি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দাবি সাম্প্রতিক বন্যায় জেলায় কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে তিন হেক্টর জমির। এর মধ্যে সোয়া হেক্টর আংশিক এবং পৌনে দুই হেক্টর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৯০ জন। তবে কৃষি বিভাগের ওই তথ্য মানতে নারাজ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছে, কৃষি বিভাগের ওই হিসাবে বাস্তব চিত্র আসেনি। ক্ষতির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি।</p> <p>গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সব ইউনিয়নই মূলত চর। আর নদের ধারে বা বেষ্টনীর ওই এলাকাতেই পাটসহ অন্যান্য শাকসবজি বেশি হয়। এখনো ফুলছড়ির বালাসীঘাট, গুণভরি, কাতলামারী, গজারিয়া  সাঘাটার হলদিয়া, সদরের কুন্দের পাড়ার ফসলি ক্ষেত ডুবে আছে। কোচখালির বৃদ্ধা আজিরণ বেগম বললেন, পাটের জমি কিছু ভাঙনের পেটে আর কিছু পানির নিচে তলিয়ে যায়। বীজতলা আর কোনো কাজে আসবে না। ঝিঙা, করলা, কাঁকরোল, পটোল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।</p> <p>জামালপুরে বন্যায় সাত হাজার ৪৭০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ৩৮৫ হেক্টর জমির বীজতলা রয়েছে। এখন শ্রাবণ মাস। রোপা আমন ধানের বীজ লাগানোর উত্তম সময়। কিন্তু কৃষকদের সব বীজতলা খেয়ে ফেলেছে বন্যার পানি। যে সময়ে কৃষকদের আমনের বীজ রোপণে ব্যস্ত সময় কাটানোর কথা, সে সময় তারা বীজতলা তৈরি করা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।</p> <p> </p>