<p>লিমন বাসার, আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) থেকে ফিরে বিজলী, রানী, কিরণমালা, সুইটি—একেকটি বাহারি নাম। ওদের ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায়ও মেলে নামের সার্থকতা। চলনে বিদ্যুত্গতি। চোখের পলকে মাইল পার হতে জুড়ি নেই। আর নানামুখী গুণের কারণে ওদের কদরও যথেষ্ট। পছন্দের প্রাণীটিকে পেতে ক্রেতাদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি।</p> <p>দৃশ্যটি উত্তরের জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথপুর মেলার ঘোড়ার হাটের। আয়োজকদের দাবি, দেশের একমাত্র ঘোড়া বিকিকিনির হাট এটি। এ কারণে সারা দেশ থেকে আনা কয়েক হাজার ঘোড়া জড়ো করা হয় এখানে। এটিকে ঘোড়ার মিলনমেলা বললেও অত্যুক্তি হবে না।</p> <p>প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে গোপীনাথপুর মন্দির প্রাঙ্গণে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুরু হয় দোলযাত্রার মেলা। ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ মেলা ঘিরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে এই আয়োজন।</p> <p>গোপীনাথের প্রধান মন্দির থেকে ঠাকুরমূর্তি বাজার মন্দিরে নেওয়ার মধ্য দিয়ে গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে এ দোলযাত্রা মেলা। রীতি অনুযায়ী বাজার মন্দিরে ঠাকুরের অবস্থান পর্যন্ত চলবে এ মেলা।</p> <p>মেলা ঘিরে প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসেছে এই ব্যতিক্রমী ঘোড়ার হাট। চলছে বেচাকেনাও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছে নানা বয়সের মানুষ।</p> <p>কুষ্টিয়া থেকে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ী শরিফুল বলেন, ‘২০ বছর ধরে এ মেলায় আসছি ঘোড়া বিক্রি করতে। প্রথম দিকে ঘোড়ার আমদানি অনেক কম ছিল। এখন অনেক ঘোড়া আসে। এ সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এবার চারটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে একটি ঘোড়া বিক্রি করেছি এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। ঘোড়াটি উচ্চতায় প্রায় ৯ ফুট। ক্ষিপ্রতার জন্য তাজি জাতের এ ঘোড়ার সুনাম আছে।’</p> <p>নওগাঁর ধামইরহাট থেকে আসা আব্দুস সবুর বলেন, ‘মেলায় বিক্রির জন্য এবার ছয়টি ঘোড়া এনেছি। ইতিমধ্যে তিনটি বিক্রি হয়ে গেছে ৩০, ৪৫ ও ৮০ হাজার টাকায়।’</p> <p>আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোপীনাথপুর মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরু-মহিষ বিকিকিনি। তবে ঘোড়ার বিকিকিনি শুরু হয়েছে বিগত ২৫-৩০ বছর হলো। এবার ঘোড়া আমদানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মেলায় কাঠের আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও পাওয়া যাচ্ছে।  মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাহারি সামগ্রী, সার্কাস, শিশুদের জন্য নাগরদোলাসহ চিত্তবিনোদনের নানা ব্যবস্থাও রয়েছে।</p> <p>গতকাল বুধবার মেলায় ঘোড়ার হাটে গিয়ে দেখা মেলে মুখভর্তি দাড়ি, গায়ে সাদা শার্ট ও লুঙ্গি পরিহিত এক ব্যক্তির। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটছেন। ঘোড়াটির গলায় লাল মালা। আছে ঘুঙুর। ঘোড়ার পিঠে কাপড় দিয়ে বানানো আসনে বসে আছে একটি শিশু। এক প্রশ্নের জবাবে একগাল হেসে বললেন, ‘এটা বিক্রি করতে হাটে আনচি। ভালো দাম প্যালে বেচমু। কিন্তু সাইজে একটু ছোট তো, তাই দাম কম কচ্চে। ১৫ হাজার দাম উটিচে, হামি ২০ হাজার হলে বেচমু। একুন ছোলপোলোক এ্যানা ঘোড়ার পিটত তুলে আনন্দ দিচ্চি।’</p> <p>কথা বলে জানা যায় লোকটির নাম সোলাইমান, বাড়ি টাঙ্গাইল। জানালেন, ঘোড়া পোষা ও বিক্রি করাই তাঁর পেশা। এ হাট থেকেই তিনি আবার বাচ্চা ঘোড়া কিনে নেবেন। বছর দুয়েক পর তা বিক্রি করবেন। একটি ঘোড়ার খাবার বাবদ দিনে ব্যয় হয় দেড় শ থেকে ২০০ টাকা। এ পর্যন্ত তিনি এ হাটে কমপক্ষে ২০টি ঘোড়া বিক্রি করেছেন। সোলাইমানের দাবি, দেশের একমাত্র বড় ঘোড়ার হাট এটি। এখানে অনেক ঘোড়া আমদানি হয়, ক্রেতাও আসে প্রচুর। বিক্রিও হয় কয়েক কোটি টাকা।</p> <p>মেলার পশ্চিম দিকে রয়েছে বিশাল বড় মাঠ। সেটি প্রস্তুত রাখা হয়েছে মূলত ক্রেতাদের ঘোড়ার দৌড়ের ক্ষিপ্রতা দেখানোর জন্য। ক্রেতারা প্রথমে ঘোড়দৌড় দিয়ে ঘোড়ার গতি পরীক্ষা করে। পরে শুরু হয় দরদাম। এ হাটে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা মূল্যের ঘোড়া উঠেছে এবার। ঘোড়া আনা হয়েছে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, জামালপুর, পাবনা, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে।</p> <p>গাইবান্ধা থেকে আসা ব্যবসায়ী আজিমুল হক জানালেন, অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ঘোড়া ‘টাট্টু’ আজকাল তেমনভাবে দেখা যায় না। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবেষ্টিত বেশ কিছু জনপদের পথে-ঘাটে এক সময় টাট্টু ঘোড়ার ছড়াছড়ি ছিল। এখন ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আনা থোবিট প্রজাতির টাট্টু ঘোড়ার গাড়ি হয়ে উঠেছে শুকনো মৌসুমে গাইবান্ধা, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়িসহ বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের যাতায়াত আর পণ্য পরিবহনের প্রধান অবলম্বন। তিনি জানান, এবার হাটে পাঁচ শর বেশি টাট্টু ঘোড়া উঠেছে। ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব ঘোড়া।</p> <p>ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া জানান, তিনি এ হাটে ২০টি টাট্টু ঘোড়া এনেছিলেন। তিন দিনে বিক্রি করেছেন ১৫টি। বালুতে চলতে পারদর্শী বলে এ প্রজাতির ঘোড়ার কদর বেশি।</p> <p>কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী রশিদুল জানালেন, পূর্ণবয়স্ক একটি দেশি ঘোড়ার বর্তমান বাজারমূল্য ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। আর নানা প্রজাতির ঘোড়া কিনতে যেতে হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী আর কুড়িগ্রামের খড়িবাড়ীর সীমান্তসংলগ্ন এলাকার হাটে। এর বাইরে মিলবে এই গোপীনাথপুর হাটে। এ কারণে ঘোড়া সংগ্রহ ও বিক্রির জন্য গোপীনাথপুরের এ হাটকেন্দ্রিক প্রস্তুতি থাকে সবারই।</p> <p>কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন শৌখিন ঘোড়সওয়ার মীর ফরিদ। তিনি বলেন, ‘হাট-বাজার, উপজেলা শহর বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি—সব জায়গায় যাতায়াতেই আমার বাহন ঘোড়া। ঘোড়ার মুখে লাগাম, গলায় ঘুঙুর, পিঠে বেল্টে আটকানো জিন। জিনের ওপর বসে এক হাতে চাবুক, অন্য হাতে লাগাম। খট খট শব্দে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।’ জানালেন, ঘোড়া পোষা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবু ঘোড়া না দেখলে থাকতে পারেন না। তাঁর সংগ্রহে মোট চারটি ঘোড়া রয়েছে। বয়সের ভারে ভেঙে পড়া শরীরেও এখনো নিজ হাতে ঘোড়ার খাবার দিয়ে থাকেন। খাবারের তালিকায় রয়েছে ছোলা, দুধ, ডিম, ঘাস ইত্যাদি।</p> <p>এবারের হাটে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকায় যে ঘোড়াটি বিক্রি হয়েছে তার মালিক আব্দুস সালাম জানান, ঘোড়াটির বয়স সাড়ে চার বছর। এটি রেসিং ঘোড়া। দ্রুত দৌড়াতে পারে। সাদা-কালো দাগওয়ালা ঘোড়াটির যত্ন নিতেন তিনি নিজেই। বাহারি ঘোড়াটি কিনেছেন যশোরের এক ব্যক্তি। মেলায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া ঘোড়াটি কালো-ধূসর রঙের মিশ্রণে তাজি জাতের। উচ্চতা প্রায় সাড়ে আট ফুট। দিনাজপুর থেকে আনা ঘোড়াটি কিনেছেন ময়মনসিংহের আব্দুল লতিফ নামের একজন ব্যাপারী।</p> <p>গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির সভাপতি আবু সাঈদ জোয়ারদার বলেন, প্রতিবছরই ঐতিহাসিক এ মেলা ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মেলার নিরাপত্তায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এবার এ হাটে কমপক্ষে দুই হাজার ঘোড়া বেচাকেনা হবে। আর হাটে টোল নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে দাম অনুসারে।</p> <p>নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা আবু সাইদ বলেন, মেলা উপলক্ষে বিপুল মানুষের সমাগম হয়েছে। তাদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি আনসার বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পুরো আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে।</p>