<p>ওষুধের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রাম মহানগরের হাজারি গলি এলাকা। সেখানকার ছোট-বড় সাড়ে চার শতাধিক ওষুধের দোকানে (ফার্মেসি) প্রতিদিন সাড়ে তিন কোটি থেকে চার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ বাজারে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ সরকারি ওষুধের পাশাপাশি আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধও অবাধে বিক্রি হয়।</p> <p>ভেজাল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট, চিকিৎসকের স্যাম্পল (ওষুধ) অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয় সেখানে। জেলা প্রশাসন ও ওষুধ প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযানের উদ্যোগ নিলেও হাজারি গলির ওষুধের দোকানের মালিকদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের কারণে তা ভেস্তে যায়। ফলে অবৈধ ওষুধের কারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।</p> <p>সর্বশেষ মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের একটি অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ভণ্ডুল করে দিয়ে বাজারের দোকানগুলো মালিকরাই বন্ধ করে দেন। দুপুরের পর একযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব দোকান। বুধবার আবার দোকান খোলা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ভণ্ডুল করার অভিযোগে</p> <p>গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে সেদিন দুপুরে মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির চট্টগ্রাম জেলা শাখা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে তারা।</p> <p>হাজারি গলি অবৈধ ওষুধের বিশাল গোডাউন-এ কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘অবস্থা এ রকম যে সেখানে কোনো ফার্মেসি থেকে ১০ হাজার টাকার ওষুধ কিনলে দুই হাজার টাকার সরকারি ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। আমদানি নিষিদ্ধ ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধের বড় বাজার হাজারি গলি।’</p> <p>ডা. সিদ্দিকী বলেন, ‘অবৈধ ওষুধের ওই খনিতে প্রশাসনের লোকজনকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কারণ ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালে সব ধরা পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেখানে অভিযান চালানো।’</p> <p>সিভিল সার্জন আরো বলেন, ‘ডিসি, পুলিশ কমিশনার, এসপির নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাবের বড় দল নিয়ে সেখানে একদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাঁড়াশি অভিযান চালালে অবৈধ ওষুধের হাট বন্ধ হয়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।’</p> <p>মঙ্গলবার হাজারি গলিতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রুহুল আমিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ৮ জুলাই থেকে সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছেন। এ সময়ে ১৪৫টি ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে ১৩৭টিতেই অনিয়ম দেখা গেছে। মালিক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে হাজারি গলির ওষুধের বিভিন্ন দোকান সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সবাই বলেছেন, সরকারি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধ ও আমদানি নিষিদ্ধ বিভিন্ন ওষুধ তাঁরা হাজারি গলির বিভিন্ন দোকান থেকে কিনেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতেই মঙ্গলবার সকালে আমরা হাজারি গলির প্রবেশমুখ কে সি দে রোড এলাকার দোকানগুলোতে অভিযান পরিচালনা করতে যাই।’</p> <p>ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘হাজারি গলির ভেতরে প্রবেশ করার আগেই মালিক-কর্মচারীরা আমাদের ওপর চড়াও হন। তার পরও আমরা দুটি ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ওষুধ জব্দ করি। সব দোকানে অভিযান পরিচালনা করলে জানতে পারব, হাজারি গলিতে কী পরিমাণ অবৈধ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।’</p> <p>রুহুল আমিন আরো বলেন, ‘মানুষ ওষুধ সেবন করে জীবন রক্ষা ও সুস্থতার জন্য। মানুষের স্বার্থে অবৈধ, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে।’</p> <p>জানা গেছে, গত ৮ জুলাই থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ফার্মেসিতে অভিযান শুরু হলে ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমিনকে বড় ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা। তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে অভিযান বন্ধ করা অথবা শিথিল করার জন্য প্রস্তাব দেন তাঁরা।</p> <p>বিষয়টি স্বীকার করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘অভিযান শুরুর এক সপ্তাহ পর থেকে চট্টগ্রাম কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির বিভিন্ন নেতা আমাকে অর্থ দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রত্যাখ্যান করায় তাঁরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত। আমি তাঁদের সাফ বলে দিয়েছি, দ্বিতীয়বার এলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা ও সহযোগিতায় এ পর্যন্ত সব অভিযান সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছি আমরা।’</p> <p>অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি সমীর কান্তি শিকদার বলেন, ‘আমাদের এখানে সাড়ে চার শ ফার্মেসির মধ্যে কেউ কেউ লুকিয়ে অবৈধ ওষুধ বিক্রি করতে পারে। তার মানে এই নয় যে পুরো বাজারে অবৈধ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার পুলিশ আমাদের যে ১২ জন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে অবিলম্বে তাদের মুক্তি না দিলে আমরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করব। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। তাদের কাজে আমরা সহযোগিতা করেছি।’</p> <p>প্রসঙ্গত, ঢাকার মিটফোর্ডের পর চট্টগ্রামের হাজারি গলি ওষুধের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার।</p> <p>চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে চট্টগ্রামের ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকেন। গত ৮ জুলাই থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১৪৫টি ফার্মেসিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ১৩৭টির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২৫টি ফার্মেসি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। তিনজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে। মোট ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে এবং আনুমানিক ১১ লাখ টাকার অবৈধ ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।</p>