<p>কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে প্রতি জুমায় খুতবা দেন একজন বাংলাদেশি খতিব। বাংলাদেশের জন্য এটি গৌরব ও আনন্দের বিষয়। একজন বাংলাদেশি হয়েও কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যেত পারলেন, তা নিয়ে পাঠকের কৌতূহল ভাঙাতে আমাদের আজকের আয়োজন।</p> <p>গত বুধবার (০৯ জানুয়ারি) ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ সেন্টারে এসেছিলেন বাংলাদেশের গর্বিত এই সন্তান। মাগরিবের নামাজে সুমধুর কণ্ঠে মিডিয়া হাউসের মুসল্লিদের মন জয় করেন তিনি। এরপর সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে খানিক সময়ের মুগ্ধকর খোশগল্পের পর্ব। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা।</p> <p>বাংলাদেশের এই কৃতী সন্তানের নাম হাফেজ কারি সাইফুল ইসলাম। তাঁর সাফল্যের শুরু ২০০৫ সালে। সে বছর ‘দুবাই হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ডে’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি।</p> <p>এরপর ২০১০ সালে আসে আরো বড় সাফল্য। জর্দানে ৬০টি দেশের সম্মিলিত তাফসিরুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তখনো তিনি পড়াশোনা করছিলেন দেশের একটি স্বনামধন্য কওমি মাদরাসায়। এরপর দাওরা হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করার পাশাপাশি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কাতার ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ লাভ করেন। ২০১২ সাল থেকে চার বছর মেয়াদে সেখানে অনার্স সম্পন্ন করেন।</p> <p>কিভাবে তিনি কাতার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুতবা প্রদানের সৌভাগ্য অর্জন করেন, সে প্রসঙ্গ খুবই চমকপ্রদ ও ঈর্ষণীয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকে কাতারের রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর চমৎকার সম্পর্ক। সে বছর ‘দুবাই হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড’ জয়ের পর থেকে রাজপরিবারের সদস্য আবদুল আজিজ বিন খালেদ আবদুল্লাহ আল-থানি তাঁকে নিয়মিত কাতারে আমন্ত্রণ করতেন। প্রতিবছর আসা-যাওয়ার টিকিট ও আনুষঙ্গিক খরচসহ দুইবার তাঁকে কাতার নিয়ে যাওয়া হতো। প্রথমবার যেতেন মাত্র এক সপ্তাহের আনন্দভ্রমণে। মাদরাসায় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিয়েই ছুটি কাটাতে ছুটে যেতেন কাতারে।</p> <p>দ্বিতীয়বার যেতেন রমজান মৌসুমে। সেখানে রাজপরিবারের সদস্যদের তারাবির নামাজে তিনি ইমামতি করতেন। তারপর তাঁদের সঙ্গে সৌদিতে গিয়ে ওমরাহ পালন করে ঈদের দিন দেশে ফিরে আসতেন। তাঁর এমন দারুণ ও সুখময় আসা-যাওয়া ২০১২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।</p> <p><strong>প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খতিবের দায়িত্বে যেভাবে</strong></p> <p>হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম জানান, কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খতিবের দায়িত্ব তিনি রাজপরিবারে কিছু সদস্যের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে পাননি। বরং আল্লাহর মেহেরবানি ও করুণা এবং নিজের যোগ্যতায় পেয়েছেন।</p> <p>জানা যায়, ২০১৫ সালে কাতার ইউনিভার্সিটিতে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় একদিন দেখলেন, পার্শ্ববর্তী অভিজাত এলাকা দাফনার রমিলার সেনাবাহিনীর অফিসারদের ২০৭ নম্বর মসজিদে খতিব চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য মনে সাধ জাগে তাঁর। কিন্তু বিষয়টি অতটা সহজ ছিল না। কারণ কাতারে ইমাম ও খতিবের নিয়োগ সরকারি পরীক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক পরিশ্রম ও সাধনার পর খুতবা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। এর পর থেকে ওই মসজিদে টানা এক বছর খতিবের দায়িত্ব পালন করার পর তাঁকে কাতারের আমিরের প্রাসাদ মসজিদে ট্রান্সফার করা হয়। বর্তমানে তিনি এ মসজিদে খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় ‘শায়খ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-উবাইদিলি’ মসজিদে ইমাম এবং তারাবির দায়িত্বও পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে।</p> <p><strong>প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুতবা দেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ</strong></p> <p>তিনি জানান, সেনাবাহিনীর মসজিদটিতে প্রদানকৃত তাঁর খুতবাগুলো রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মনে ছুঁয়ে যায় বেশ। এরপর ২০১৭ সালের রমজানে হঠাৎ ফোন করে তাঁকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে জুমার খুতবা দিতে হবে। সেখানে কাতারের প্রেসিডেন্ট ও রাজপরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন।</p> <p>এমন গুরুভার দায়িত্ব সম্পর্কে ফোন পাওয়ার পর বেশ চিন্তায় পড়ে যান তিনি। মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অজানা শঙ্কার ডালপালা গজাতে শুরু করে। কিন্তু জুমার দিন আগেভাগে কর্তৃপক্ষ গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পরে মনে আশার সঞ্চার হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করতে থাকি।</p> <p>এরপর ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই প্রথমবারের মতো খুতবা দিয়ে রাজপরিবারের মুসল্লি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মন জয় করেন। তখন থেকে তাঁর এ গুরুদায়িত্ব এখনো বলবৎ রয়েছে। বাংলাদেশের সুনাম কুড়ানোর পাশাপাশি তিনি দায়িত্ব পালনেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।</p> <p>হাফেজ সাইফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নয়নপুর পৌরসভা এলাকায়। তাঁর বাবার নাম ডা. ওয়ালিউর রহমান। স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি মাদরাসায় ভর্তি হন। দেশের খ্যাতিমান কোরআনে হাফেজ মাওলানা আবদুল হকের কাছে হিফজ করেন। এরপর ২০১১ সালে দাওরা হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম মাদরাসা থেকে। ২০১২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে কাতার ইউনিভার্সিটিতে গমন করেন। ২০১৭ সালে সেখান থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স সম্পন্ন করেন।</p> <p>দীর্ঘ আলোচনায় জানা যায়, আরবি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার প্রতি তাঁর ছোটবেলা থেকেই আলাদা টান ছিল। আরবদের স্টাইলে কথা বলতে চাইতেন। তাদের বাচনভঙ্গি অনুসরণ করতেন। এতে করে তাঁর বক্তৃতাশৈলী সুন্দর হয়ে ওঠে।</p> <p><strong>দেশ-বিদেশে সাফল্যও অর্জন</strong></p> <p>হাফেজ কারি সাইফুল ইসলামের দেশ-বিদেশে অনেক সাফল্য রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি অনেক পুরস্কার জিতেছেন। তার মধ্যে ২০০৪ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান, ২০১০ সালে জর্দানে আন্তর্জাতিক তাফসিরুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ২০০৪ সালে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান, ২০০৯ সালে ইরান আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান, ২০১৫ সালে আবারও জর্দানে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে বিদেশে দেশের মান উজ্জ্বল করেন।</p> <p><strong>বিদেশে থেকেও দেশ ও দশের সেবা</strong></p> <p>ধর্মীয় শিক্ষায় বৃহৎ পরিসরে কাজ করার মানসে তিনি ঢাকার শনিরআখড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আন্তর্জাতিক মানের কওমি ও হিফজুল কোরআন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মারকাজুত তানজিল আল ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা বিশ্বব্যাপী দ্বিনের সেবার পাশাপাশি দেশের মান উজ্জ্বল করবে বলে তিনি স্বপ্ন দেখেন। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ চৌরাস্তায় তিনি একটি মাদরাসার দেখাশোনা করেন। পর্যায়ক্রমে মাদরাসাটির মানগত পরিচর্যা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করবেন বলে জানান তিনি।</p> <p>অল্প কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে দেশে এলেও তিনি বসে নেই। কোরআনের আলো ও জ্ঞান নিয়ে ছুটে চলছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের চিন্তা ও মানুষের খোরাক বিতরণ করছেন।</p> <p>এ ছাড়া দীর্ঘ পরিসরে নিজ এলাকা ও দেশের মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন বলে জানান। কোনো প্রয়োজনে কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে কিংবা কিছু জানার আগ্রহ থাকলে তাঁর ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে (০১৬৭০৯০৫১৬৮) যোগাযোগও করা যাবে বলে জানান তিনি।</p> <p>লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক</p>