<p>মহাকালের স্রোতধারায় আমরা আমাদের চিরায়ত ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিস্মৃত হয়েছি। এখন আর কাকডাকা ভোরে ঘরে ঘরে আল-কোরআনের মধুর আওয়াজ শোনা যায় না। মসজিদ আঙিনা বা মক্তবে শিশুদের কলকাকলি মুখরিত অবস্থা দেখা যায় না; বরং দেখা যায়, বুয়ারা অর্ধজাগ্রত শিশুকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানরাজ্যের স্বর্ণালি দুয়ারে! সেকি বাহারি আয়োজন! ওয়ার্ড বুক, টিফিন বক্স, ওয়াটার ব্যাগ—শিশুটি যেন নিল আর্মস্ট্রংয়ের মতো চাঁদের দেশে যাচ্ছে। বিশাল বোঝাটি ওই শিশু বহনে অক্ষম। এভাবেই গড়ে ওঠে প্রাণহীন, শৈশববঞ্চিত প্রজন্ম। এই শিক্ষাব্যবস্থায় বিরক্ত শিশু একসময় হয়ে ওঠে পাঠশালাবিমুখ। পা বাড়ায় নিষিদ্ধ পথে। তাদের একটি দল একসময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।</p> <p>জনজীবনে ‘ত্রাস’ তৈরির অপতৎপরতাকে ‘সন্ত্রাস’ বলে। Terrorism বা আরবি ‘ফিতনা-ফ্যাসাদ’ হলো সন্ত্রাস শব্দের সমার্থক। অস্ত্র ও শক্তির জোরে প্রকাশ্যে পরিচালিত এমন তৎপরতাকে আরবিতে ‘ইরহাব’ বলা হয়। নিরস্ত্র অসহায় মানুষের ক্ষতি সাধন বা সর্বস্ব লুটে নেওয়ায় জড়িতকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘মুহারিব’, যার প্রচলিত অর্থ ডাকাত। আর ফারসি ‘জঙ্গ’ অর্থ যুদ্ধ, তুমুল কলহ। আর জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা বা কুস্তিগির। তাই ‘জঙ্গ’ বা জঙ্গিদের তৎপরতাকে ‘জঙ্গিবাদ’ বলা হয়।</p> <p>পীর-আউলিয়ার পুণ্যস্পর্শে ধন্য আমাদের প্রিয় স্বদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধ্যাত্মিকতা ও ঈমানি শক্তিতে। ইসলামের আদর্শ, কর্ম, সততা, সাধুতায় পরিপূর্ণ আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়।</p> <p>ইসলামে অনাচার, অন্যায় তৎপরতা ও লুণ্ঠন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যেসব মানুষ আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ চালায় এবং পৃথিবী তথা জনসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালায়, তাদের জন্য যে শাস্তি রয়েছে তা হলো—তাদের হত্যা করা হবে অথবা তাদের ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে ফেলা হবে কিংবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের অপমান। আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে আরো বড় শাস্তি।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩৩)</p> <p>ন্যায়সংগত কারণ ও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে মেরে ফেলার অনুমতি ইসলামে নেই। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা হলো, ‘কোনো নর হত্যা কিংবা পৃথিবী বা সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণে বিচারের রায় ছাড়া যদি কেউ কোনো মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল...।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২)</p> <p>ইতিহাস বলে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শান্তি ও সংলাপের পথে। আধ্যাত্মিকতা, ইবাদত, ইখলাস, দোয়া, দাওয়াত ও তাবলিগ, মানবসেবা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি চেতনার কারণে ইসলামকে বলা হয় শান্তির ধর্ম।</p> <p>তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধে ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই। অথচ অজ্ঞাত কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ‘ইসলাম শিক্ষা’ অযত্ন-অবহেলার শিকার। স্কুলে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটি ‘ইসলাম ধর্ম শিক্ষা’ নামে প্রচলন করা গেলে হয়তো শিশু-কিশোর মননে ‘ধর্মচিন্তা’ স্পষ্টতর হবে। স্কুলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাস্ট পিরিয়ডে থাকে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ ক্লাস। শুধু এ কারণেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পায় না। এর ফলে অনেকে ‘গোল্ডেন’ থেকে বঞ্চিত হয়। এমন অবহেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত থেকে যায় ধর্মীয় চেতনাবোধ।</p> <p>কলেজ পর্যায়েও ইসলাম শিক্ষার অবস্থা ভালো নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিষয়বিন্যাস আরো হতাশাজনক। নীতিমালা অনুযায়ী ‘ইসলাম শিক্ষা’ স্রেফ ঐচ্ছিক। এতে আশঙ্কাজনক হারে সব কলেজেই ইসলাম শিক্ষায় ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে! বোর্ডগুলোতে ২০১৩/২০১৪ এবং ২০১৫/২০১৬-এর পরীক্ষার্থীসংখ্যা দেখলেই বিষয়টি স্পস্ট হবে। ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষেও বিষয়টি তৃতীয় বা চতুর্থ হিসেবে নেওয়ার সুযোগ ছিল (‘ক’, ‘খ’ গুচ্ছবিন্যাস অনুসারে)। আমি অধ্যাপনার ২৬ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আগে সব গ্রুপের সবাই বিষয়টি নিত। বিশেষত, ১৯৯৮ বা আরো আগে বিষয়টি আবশ্যিকের গুরুত্ব রাখত। ডিগ্রি পর্যায়েও নানা নিয়মের প্রতিবন্ধকতা ও সুযোগ সংকুচিত হওয়ার ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নিতে পারে না।</p> <p>ইসলামী শিক্ষার বিকাশে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত আন্তরিক, অথচ ‘ইসলাম শিক্ষা’ বিষয়টি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে গেছে! কিন্তু ইসলামী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই এবং তা বাধ্যতামূলক হওয়াই জরুরি ও সময়ের দাবি। আমাদের দাবি হলো, সর্বস্তর ও সব গ্রুপের মুসলিম ছাত্রদের জন্য ‘ইসলাম শিক্ষা’ উন্মুক্ত রাখা হোক। এতেই ইসলাম সম্পর্কে জানা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।</p> <p>লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান</p> <p>ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ</p> <p>কাপাসিয়া, গাজীপুর।</p>