<p>ইসলাম শাশ্বত সুন্দরের ধর্ম। বিশ্বাসী মানুষের ধর্ম। মানবতার ধর্ম। ইসলাম উদারতার সদর দরজা উন্মুক্ত করেছে আর কপাটবদ্ধ করেছে কঠোরতার। শান্তি ও সভ্যতার সোনালি অধ্যায় রচনায় আপসহীন ধর্ম যেমন ইসলাম, তেমনি অসভ্যতা আর অশান্তির হৃৎপিণ্ডে আঘাত হেনেছে বারবার।</p> <p>পৃথিবীর প্রথম সূর্যোদয় থেকে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসুলরা। তাঁরা আল্লাহর খলিফা। খলিফা আরবি শব্দ। এর অর্থ উত্তরাধিকারী, প্রতিনিধিত্বকারী। ইসলামী পরিভাষায়, খলিফা হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি যাবতীয় বিষয়ে শরিয়ত অনুযায়ী উম্মতকে পরিচালিত করেন। ইসলামী রাষ্ট্রে খলিফা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে।</p> <p>মানবতার সুভাসিত ঘ্রাণ আর শান্তির বাণী নিয়ে সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেন সর্বকালের সেরা মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি পৃথিবীর সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক কর্মসূচি, সমাজদর্শন, রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি মানবসভ্যতার আকাশে এক নতুন চমক। এক নয়া দিগন্ত। তিনি গঠন করলেন ইসলামী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনা করলেন ইসলামী শরিয়া নির্দেশিত পদ্ধতিতে। যে পদ্ধতির আবিষ্কারক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। ইসলামী রাষ্ট্র হলো, যেখানে সরকারের কার্যের প্রথম ভিত্তি হবে শরিয়া। আল্লাহ তাআলা যেসব আকিদা ও আমল তথা বিশ্বাস ও কর্ম মানুষের জন্য প্রণয়ন করেছেন, তা-ই হলো শরিয়া।</p> <p>ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি খোলাফায়ে রাশেদিন। ইসলামের খলিফারা সুন্দর ও পবিত্র পৃথিবীর জন্য তিন পদ্ধতিতে খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করেছেন।</p> <p><strong>জনগণ কর্তৃক মনোনয়ন :</strong> রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ওমর (রা.) এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন। রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.)-এর সম্পর্ক, ইসলামের জন্য আবু বকর (রা.)-এর  ত্যাগ নিয়ে কথা বলেন। আবু বকর (রা.)-কে রাষ্ট্রপ্রধান বানানোর প্রস্তাব দেন।  জনগণ সমর্থন জানায়। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রথম খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম পুরুষ মুসলমান। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর মিরাজ গমনের সত্যায়নকারী। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সঙ্গী। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ পুরুষ ও রাসুলের একান্ত কাছের মানুষ। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় অসুস্থতার সময় আবু বকর (রা.) জামাতে নামাজের ইমামতি করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭১৩)</p> <p>মুসলমানদের জামাতের ইমামতিও খেলাফতের ইঙ্গিত বহন করে। এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘এক নারী মহানবী (সা.)-এর কাছে এলো। তিনি তাঁঁকে আবার আসার জন্য বললেন। ওই নারী বলল, আমি এসে যদি আপনাকে না পাই তাহলে কী করব? মহানবী (সা.) বলেন, যদি আমাকে না পাও, তাহলে আবু বকরের কাছে আসবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৫৯)</p> <p>এ হাদিসটি স্পষ্টভাবে আবু বকর (রা.)-এর খলিফা হওয়ার প্রমাণ বহন করে।</p> <p><strong>পূর্ববর্তী খলিফা কর্তৃক মনোনয়ন :</strong> ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর সময় বিশিষ্ট সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ওমর (রা.)-কে খলিফা নির্বাচিত করেন। অতঃপর বিষয়টি উপস্থিত সাহাবিদের সম্মুখে উপস্থাপন করলে সবাই সম্মতি ও ঐকমত্য পোষণ করেন। (তারিখে তাবারি : ২/৩৫২)</p> <p>ওমর (রা.) ছিলেন ন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারী। এ কারণে তাঁকে ‘ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আমিরুল মুমিনিন উপাধিটি সর্বপ্রথম তাঁর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার পর যদি কেউ নবী হতো, তাহলে সে হতো ওমর। হাদিসে বিবৃত হয়েছে, রাসুল (সা.) একবার স্বপ্নযোগে বেহেশতে যান। সেখানে ওমরের জন্য বরাদ্দকৃত প্রাসাদ দেখেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬৭৯)</p> <p><strong>মজলিসে শুরা কর্তৃক মনোনয়ন :</strong> ওমর (রা.) আহত হওয়ার পর বিশিষ্ট সাহাবিদের সমন্বয়ে মজলিসে শুরা গঠন করেন। মজলিসে শুরায় ছিলেন আলী, ওসমান, জুবায়ের, তালহা, সাদ ও আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)। মজলিসে শুরার সবাই ছিলেন দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি। তাঁরা মিলে ওসমান (রা.)-কে খলিফা নির্বাচিত করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭০০)</p> <p>ওসমান (রা.) নিজের সব কিছু ইসলাম ও রাসুল (সা.)-এর জন্য উৎসর্গ করেন। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর দুই মেয়ের জামাতা—জিননুরাইন।</p> <p>খলিফার নিচে যেসব পদ রয়েছে, সেসব পদে নিয়োগ দেওয়ার অধিকার খলিফার। খলিফা যোগ্য ও আমানতদার ব্যক্তিদের নির্বাচিত করবেন। এবং তাদের সেসব পদে নিয়োগ দেবেন। আল্লাহ তাআলা শাসকের কাছে এটা আমানত রেখেছেন। যোগ্য ও বিশ্বস্ত লোককে এসব পদের জন্য নির্বাচন করা হলে এ আমানত যথাযথভাবে আদায় হবে। আর ইসলামের চারজন খলিফাই শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর বানিয়েছিলেন।</p> <p>রাসুল (সা.)-এর চার খলিফাই জনগণের মত ও সমর্থনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা কেউ খেলাফত লাভের দাবিদার ছিলেন না। পদের জন্য চেষ্টাকারীও ছিলেন না। এমন কামনা-বাসনাও তাঁদের মনে জাগেনি। তাঁরা খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছেন মানুষের খেদমতে। রাতের আঁধারে, নির্জন পল্লীতে, গ্রাম আর শহরের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতেন অসহায় মানুষের খোঁজে। খোঁজ নিতেন, কে না খেয়ে আছে। কার উনুনে আগুন জ্বলছে না। সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন অভিযোগ জানানোর সদর দরজা। তাঁরা মানুষের ভেতরের কষ্ট আর গল্প জানতে অধীর থাকতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, দায়িত্ব ও পদ হচ্ছে আমানত। আল্লাহ তাআলা শাসকের কাছে এটা আমানত রেখেছেন।</p> <p>ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের অবশ্যই বিশেষ কিছু গুণ থাকতে হবে। যে গুণের কথা বলেছে ইসলাম। এ গুণ ছাড়া কেউ মুসলমানদের সত্যিকারের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। যেমন—১. রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই ঈমানদার তথা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হতে হবে। ২. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বগুলো উত্তমরূপে পালনের যোগ্যতা। ৩. রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি এবং বুদ্ধিমত্তায় সর্বাগ্রসর। নিছক প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ও উত্তম নেতৃত্বের গুণাবলিই ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। ৪. রাষ্ট্রনেতাকে ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষতা ও সুবিচারের অধিকারী হতে হবে। ৫. পুরুষ হতে হবে। কারণ নারীরা অনেক সময় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে পারেন না। তাঁদের হৃদয় কোমলতা ও স্নেহে ভরপুর। তবে আধুনিক ইসলামিক স্কলাররা পুরুষ উপদেষ্টা রাখার শর্তে এ বিষয়ে অবকাশ রয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন। ৬. আইন-জ্ঞানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা থাকতে হবে। ৭. দেশের স্বাধীন নাগরিক হতে হবে। ৮. জন্মসূত্রে পবিত্র হতে হবে। অবৈধ সন্তান হতে পারবে না। কোনো কৃপণ, মূর্খ, নির্দয়, অন্য রাষ্ট্রের ভিন্নতর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট, ঘুষখোর, রাসুলের সুন্নত উপেক্ষাকারী ব্যক্তি মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না।</p> <p><strong>লেখক :</strong> ইসলামী গবেষক</p>