<p>পৃথিবীতে মানুষের আগমনের আগে থেকেই ভাষার প্রচলন শুরু হয়। আদি মানব হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাতে ভাষাজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩১)</p> <p>তাফসিরে কবিরের ভাষ্য মতে, আদম (আ.)-কে পৃথিবীর সব কিছুর নাম ও বৈশিষ্ট্য সব ভাষায়ই শেখানো হয়েছিল। এই ভাষাজ্ঞানের দরুন তিনি ফেরেশতাদের সেজদা লাভের মর্যাদা পেয়েছিলেন। অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের বিশেষ পার্থক্য ভাষাজ্ঞান। পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা অগণিত। বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, পৃথিবীতে দুই হাজার ৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। তবে সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে বর্তমানে সাত হাজার ৯৯টি ভাষা চলমান। অঞ্চলভেদে ভাষার পরিবর্তন হয়। ভাষার এই পরিবর্তনে রয়েছে মহান স্রষ্টার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘তাঁর এক নিদর্শন হলো তোমাদের বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র্য।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২২)</p> <p>ভাষা উচ্চারণের যন্ত্রপাতি তথা জিহ্বা, ঠোঁট, তালু ও কণ্ঠনালি পৃথিবীর সব মানুষের এক ও অভিন্ন। অথচ সবার মুখের ভাষা এক নয়। বিধাতার এ এক অপার কারিশমা। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়, পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। কোনো ভাষাই বিদ্বেষের বস্তু নয়। ভাষাবিদ্বেষ জাহেলিয়াতের স্বভাব।</p> <p><strong>মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব </strong></p> <p>মানুষ জন্মের পর যে ভাষায় কথা বলতে শেখে, সেটি তার মায়ের ভাষা। একে মাতৃভাষা বলে। এ ভাষায় মানুষ কথা বলতে ও লিখতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, অন্য কোনো ভাষায় ততটা হয় না। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সুগভীর। এ ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আত্মার। পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের লোকের কাছে তার মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের অনুরাগ মজ্জাগত ও চিরকালীন। তাই মাতৃভাষায় পাণ্ডিত্ব অর্জন ও চর্চার প্রতি ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আরবিভাষী। তিনি বলেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।’ প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও মহানবী (সা.)-এর মুখনিঃসৃত ভাষা ছিল সাহিত্যের মানদণ্ডে অত্যন্ত উঁচু মাপের। তাঁর বক্তৃতা ও বাচনভঙ্গি ছিল অতুলনীয়। তাঁর রেখে যাওয়া হাদিসের ভাণ্ডার এবং ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনের ভাষা আরবি সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। রাসুল (সা.) শৈশবেই বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন এবং বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতেন, যা শুনে লোকেরা আশ্চর্য হয়ে যেত। সুতরাং মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করা বিশ্বনবী (সা.)-এর অন্যতম সুন্নত। ইসলামের অমীয় বাণী স্বজাতির কাছে সুন্দরভাবে উপস্থানের জন্য মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। এর সমর্থন পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪) আসমানি প্রসিদ্ধ চারটি কিতাব চার ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। দাউদ (আ.)-এর প্রতি জবুর অবতীর্ণ হয়েছে ইউনানি ভাষায়, যা তাঁর জাতির ভাষা ছিল। মুসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে হিব্রু ভাষায়, যা ছিল ইহুদিদের মাতৃভাষা। ঈসা (আ.)-এর প্রতি অবতীর্ণ ইঞ্জিলের ভাষা ছিল সুরিয়ানি (গ্রিক), যা খ্রিস্টানদের মাতৃভাষা ছিল। আর আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ কোরআনের ভাষা আরবি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যদি অনারব ভাষায় কোরআন অবতরণ করতাম, তখন তারা (মক্কাবাসী) বলত, এর আয়াতগুলো পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য! কিতাব নাজিল হয়েছে অনারব ভাষায়, আর নবী হলেন আরবিভাষী! (সুরা : হা-মীম সিজদা, আয়াত : ৪৪)</p> <p>সুতরাং মাতৃভাষার গুরুত্ব আল্লাহ পাকের কালাম এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বাণী থেকে স্পষ্ট অনুমেয়। স্বয়ং বিশ্বনবী (সা.) বিশুদ্ধ আরবি ভাষা চর্চা করতেন। এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে বাইরে থেকে অনুমতি প্রার্থনা করেন এভাবে : ‘আ-আলিজু’? নবীজি (সা.) খাদেমকে বললেন, তাকে অনুমতি প্রার্থনার তরিকা শিক্ষা দাও। তাকে বলো—‘আসসালামু আলাইকুম, আ-আদখুলু?’ এ শিক্ষা পেয়ে সাহাবি অনুমতি প্রার্থনা করলে নবীজি তাকে অনুমতি দিলেন। (আবু দাউদ)</p> <p>স্মর্তব্য যে—‘আলিজু ও আদখুলু’ উভয়টির অর্থ ‘আমি কি প্রবেশ করতে পারি?’ কিন্তু দ্বিতীয় শব্দটি অধিকতর উচ্চাঙ্গের এবং প্রবেশের অনুমতি চাওয়ার ক্ষেত্রে এটিই যথার্থ। ভাষার উপযোগিতা বিবেচনা করে সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহারই ভাষারীতির কাম্য। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশ্বনবী (সা.)-এর উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)</p> <p><strong>লেখক :</strong> মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী, গাজীপুর।</p>