<p>বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রযুক্তির যুগে তিনটি ‘W’ অক্ষরের  কল্যাণে সব কিছু এখন হাতের মুঠোয় www. (world wide wave)। প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের আগে আরবে আইয়ামে জাহেলিয়াতের বৈশিষ্ট্য বোঝাতেও তিনটি ‘W’ অক্ষরের  ব্যবহার ইতিহাসে দেখা যায়। মদ (wine) নারী (women)  ও যুদ্ধ (war)। জাহেলিয়াতের আবহেও আরবদের সাংস্কৃতিক প্রয়াস অব্যাহত ছিল। তাদের কতগুলো আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। আইয়ামে জাহেলিয়াতে আরবরা যুদ্ধবিদ্যা, অতিথিসেবা, পশুপালন, দেশভ্রমণ, আন্তদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ছিল বিখ্যাত। শিল্প-সাহিত্যেও তারা কম যায়নি। সে সময়ের ইতিহাসখ্যাত ছিল ‘উকাজ মেলা’। কবিতা উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ সাতটি কবিতা স্থান পেয়েছিল পবিত্র কাবার দেয়ালে। এটিকে বলা হয় ‘সাবউল মুয়ল্লাকাত’। সে সময় পারস্যে নববর্ষ পালন ও ঘোড়দৌড় উপলক্ষে প্রচলিত দুটি উৎসব ছিল ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’। এত  কিছুর মধ্যে ছিল না মানবতা ও নৈতিকতার ছোঁয়া। বরং ছিল সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চা। সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি হলো অনেকটা ঘাতকের হাতের ছুরি আর ডাক্তারের হাতের ছুরির মতোই। তাই তো প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়তের আগের সময়কে ‘মূর্খতার যুগ’ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।</p> <p>প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়তের আগে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব অপরিহার্য করে তুলেছিল। তাই অনাচার, অসভ্য ও অসত্যের নিকষ অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর আবির্ভাব হলো মহাসত্যের চিরন্তন জ্যোতিষ্কের উদয়।</p> <p>সুস্থ সংস্কৃতি হলো মানব মননের সুকোমল অভিব্যক্তি, যা ভূগোল ও বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে পরিশীলিত ঐক্য ও বিবেকের জাগরণ ঘটায়।</p> <p>সংস্কৃতির আরবি প্রতিশব্দ ‘সাকাফাহ’ অর্থ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ পাওয়া, পরিশীলিত, মার্জিত, সজ্জিত, রুচিসমৃদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। অন্যদিকে সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Culture। এর অর্থ হচ্ছে কর্ষণ করা। জমিকে যেমন কর্ষণ করে মসৃণ ও উৎপাদন উপোযোগী করা হয়, তেমনি সদাচার ও ধার্মিকতার অনুশীলনের মাধ্যমে যখন ব্যক্তি বা জাতি পরিশীলিত হয়ে ওঠে, তখনই Cultured man বা Cultured nation বলা হয়।</p> <p>আমরা মুসলমান। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। সেটা হলো ইসলামী সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতি একত্ববাদ ও নবুয়তের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। ইসলামী জীবনাদর্শ ও শরিয়ার বিধান অনুশীলনের ফলে মানুষের ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডে যে রুচিশীল ও কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে, তা-ই ইসলামী সংস্কৃতি।</p> <p>প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, বাংলা নববর্ষ পালনে ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজে’র যোগসূত্র লক্ষণীয়। মুসলিম শাসকদের ‘ফসলি ও ভূমি কর’ আদায়ের সুবিধার জন্যই বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়। ওই সময় সুবে বাংলায় মহররম ছিল বৈশাখ। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলে চান্দ্রমাসভিত্তিক বছরে ১০-১১ দিনের তারতম্যে সন-তারিখের হিসাব মেলাতে সমস্যা দেখা দেয়। ‘মুসলিম ফসলি সন’ প্রবর্তনের আগে অগ্রহায়ণ থেকে বছর গণনা হতো। ‘অগ্র’ অর্থ শুরু ‘হায়ণ’ অর্থ বছর। অন্য মতে ‘অগ্র’ অর্থ শ্রেষ্ঠ, ‘হায়ণ’ অর্থ ধান। কেননা এ সময় প্রধান ফসল আমন বা শ্রেষ্ঠ ‘হৈমন্তিক’ ধান কৃষকের ঘরে উঠত। তবে বর্ষা শেষে খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের অসুবিধা বিবেচনায় তা শুষ্ক মৌসুমে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ পটভূমিতে হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি নতুন সৌর সন উদ্ভাবন করেন। যার কার্যকারিতা সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ (মতান্তরে ৯৯৩) হিজরি।</p> <p>‘বিশ্ব ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ’ ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। কাজেই বাংলা নববর্ষও হতে পারে আমাদের উৎসব। আমরা একে এভাবে উদ্‌যাপন করতে পারি—</p> <p>♦         নববর্ষকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে শুকরিয়া আদায় করা।</p> <p>♦         নববর্ষের আনন্দ দুস্থ-দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করা।</p> <p>♦         নববর্ষে অভাবী মানুষের খোঁজ-খাতির, তাদের খাদ্য ও পোশাক দান করা।</p> <p>♦         পহেলা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন।</p> <p>♦         পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন।</p> <p>♦         পহেলা বৈশাখ দেনা-পাওনা হালনাগাদ করার দিন।</p> <p>♦         পহেলা বৈশাখ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন।</p> <p>♦         ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন হতে পারে এটি।</p> <p>ইসলামে নির্দোষ বিনোদন, উৎপাদনমুখী তৎপরতা সমর্থিত। নববর্ষে মেহনতি কৃষক খাজনা আদায়ের আগ্রহে বলত, ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি....।’ কিন্তু বর্তমানে নববর্ষের গর্বিত অতীত ভুলে তা পালিত হয় শহুরে ঘরানায়। হাড়ভাঙা শ্রমে ক্লান্ত যে কৃষক ঋণে জর্জড়িত, তার কাছে বাংলা নববর্ষের আবেদন কতটুকু? বরং ব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ডিংয়ের কল্যাণে বসছে বাণিজ্যিক পসরা। নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।</p> <p>উৎসবের আবহে নারী ও পুরুষের অবাধ-অবাধ্য মেলামেশা ইসলামে অনুমোদিত নয়। ‘চোখের হেফাজত’ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পর্দা বজায় রাখা একটি ‘দায়েমি ফরজ’ বা সার্বক্ষণিক বাধ্যতামূলক বিধান। এসব বিষয়ে সুরা আহজাব, সুরা নুর ইত্যাদিতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।</p> <p>বিনোদন যেন অপচয়ের কারণ না হয়, তা-ও খেয়াল রাখা জরুরি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬-২৭)</p> <p>পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, বিজাতীয় অনুকরণ ইসলাম সমর্থন করে না। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ বা সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫১২)</p> <p> </p> <p><strong>লেখক </strong>: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ</p> <p>কাপাসিয়া ডিগ্রি  কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর</p> <p> </p>