<p>গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছি তাবলিগ জামাতের ছয় মূলনীতি নিয়ে। সে মূলনীতি যথাযথ অনুসরণ করার জন্য বিশেষ পাঁচ কাজের কথা বলা হয়। কাজগুলো হলো—এক. প্রতিদিন মাশোয়ারা (পরামর্শ করে চলা)। দুই. প্রতিদিন তালিম, একটি নিজের মহল্লা বা পাড়ার মসজিদে, অন্যটি নিজের ঘরে। তিন. প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দাওয়াতের কাজে মেহনত। চার. সপ্তাহে গাস্ত করা, এক দিন নিজের মসজিদে, আরেক দিন পাশের পাড়ার বা মহল্লার মসজিদে। পাঁচ. প্রতি মাসে তিন দিন আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে মেহনত করা।</p> <p>নিজের জন্যই এটা করা প্রয়োজন। দ্বিন শেখার জন্য অবশ্যই দুনিয়ার কাজ থেকে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য আলাদা করে নেওয়া প্রয়োজন। দুনিয়ার চাকরিবাকরির জন্য কি আমরা ঘরসংসার অল্প সময়ের জন্য ছেড়ে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিই না! তাহলে আখেরাতের জন্য করলে দোষ হবে কেন? মানুষের কি আখেরাত প্রয়োজন নেই, যেখানে তাকে থাকতে হবে অনন্তকাল।</p> <p>পাঁচ কাজের প্রথমটি মাশোয়ারা, এর তাত্ত্বিক ভিত্তিটিও পবিত্র কোরআন থেকে এসেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, নামাজ পড়ে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে কর্মসম্পাদন করে...।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৩৮)</p> <p>মুফতি শফি (রহ.) পবিত্র কোরআন তাফসির করতে গিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, হজরত আলী মুর্তজা (রা.) একবার রাসুলে পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অবর্তমানে আমরা যদি এমন কোনো ব্যাপারের সম্মুখীন হই, যাতে কোরআনের কোনো ফয়সালা নেই এবং আপনার পক্ষ থেকেও কোনো ফয়সালা না পাই, তবে আমরা সে ব্যাপারে  কী করব? জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, এর জন্য আমার উম্মতের ইবাদতকারীদের একত্রিত করবে এবং পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কর্তব্য স্থির করবে; কারো একক মতে ফয়সালা কোরো না। [মুফতি শফি, পবিত্র কোরআনুল কারিম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসির), মদিনা মোনাওয়ারা, ১৪১৩ হিজরি, পৃষ্ঠা ১২২০]</p> <p>বায়হাকি শরিফের হাদিস গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর ইরশাদ বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি কোনো কাজের ইচ্ছা করে, তাতে পরামর্শ গ্রহণ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে সঠিক বিজয়ের দিকে হেদায়েত করবেন। ইমাম বুখারি আল আদাবুল মুফরাদে হজরত হাসান থেকে বর্ণনা করেন, যখন কোনো সম্প্রদায় পরামর্শক্রমে কাজ করে, তখন তাদের অবশ্যই সঠিক পথনির্দেশ দান করা হয়। পবিত্র কোরআন ও পবিত্র হাদিসের উল্লিখিত সূত্রগুলো থেকে মুসলিমের জীবনে পরামর্শের গুরুত্বটি বোঝা যায়। তাবলিগ জামাত এ জন্য দুনিয়া ও আখেরাত যেকোনো ব্যাপারেই মাশোয়ারা বা পরামর্শকে জরুরি করে দিয়েছে।</p> <p>দ্বিতীয় কাজ হিসেবে মসজিদ ও ঘরে তালিম করার কথা বলা হয়েছে। একবার আবু হোরায়রা (রা.) বাজারে গিয়ে লোকদের বলতে লাগলেন—আরে, তোমরা এখানে বসে আছ, অথচ মসজিদে নবী (সা.)-এর ওয়ারিশ সম্পদ বণ্টন হচ্ছে। লোকজন দৌড়ে মসজিদে গিয়ে দেখল, সেখানে কিছুই বণ্টন হচ্ছে না। তারা আবু হোরায়রা (রা.)-এর কাছে গিয়ে বলল, আমরা তো মসজিদে কিছুই বণ্টন হতে দেখলাম না। আবু হোরায়রা তাদের বললেন, তোমরা সেখানে কী দেখতে পেয়েছ? তারা বলল, আমরা দেখলাম, মসজিদে কিছু লোক সুরা-কেরাত মশ্ক করছে, কিছু লোক জিকির করছে। আবু হোরায়রা বললেন, এগুলোই উম্মতের জন্য নবী (সা.)-এর ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তি। তাবলিগ জামাতও প্রতিদিন ঘরে ও মসজিদে তালিম [কোরআন ও হাদিস থেকে পাঠ, সুরা-কেরাত মশ্ক এবং মোজাকারা (আমলের আলোচনাকে)] জরুরি করেছে। যে ঘরে নিয়মিত তালিম হয়, সে ঘর থেকে বদ্বিন দূর হয়ে যায়।</p> <p>তৃতীয় কাজ হলো, প্রতিদিন দাওয়াতের কাজে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা মেহনত বা সময় লাগানো। নবী (আ.)-গণ আমাদের নবী (সা.) এবং সাহাবি আজমাইন (রা.) দাওয়াতের মেহনতের কাজে নিজেদের জীবনের পুরো সময়টুকুই ব্যয় করেছেন। একবার নবী (সা.) সারা দিন দাওয়াতের কাজে মেহনত করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে একটি কম্বল গায়ে দিয়ে মাত্র শুয়েছেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তাআলার ওহি নাজিল হয়ে গেল, ‘হে কম্বলওয়ালা নবী! উঠুন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সতর্কবাণী (সর্বত্র) প্রচার করতে থাকুন। প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।’ (সুরা : মুদ্দাসির, আয়াত : ১-৩) অর্থাৎ দাওয়াতের কাজে কোনো বিরাম নেই। সেখানে আড়াই ঘণ্টা বর্তমান মানবজাতির জন্য সামান্যই চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এ আড়াই ঘণ্টাকে আট ঘণ্টায় বাড়ানো হয়েছে।</p> <p>চতুর্থ কাজ হলো, সপ্তাহে দুটি গাস্ত করা। গাস্ত ফারসি শব্দ, এর অর্থ হলো, দ্বিনের কাজে কিছু সময় ঘোরাফেরা করা। একটি নিজের মসজিদে, অন্যটি পাশের কোনো মসজিদে। সাহাবায়ে কেরাম এভাবেই দাওয়াতের মেহনত করেছেন। নিজেদের মহল্লায় করেছেন, পাশের মহল্লায়ও করেছেন। সে রীতিই তাবলিগ জামাত অনুশীলন করার চেষ্টা করছে।</p> <p>পঞ্চম কাজ, মাসে তিন দিন সময় লাগানো, এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায়, এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় গিয়ে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য দুনিয়ার কাজ, পরিবারের কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দ্বিন শেখার চেষ্টা করা। একই সঙ্গে যা শিখলাম, তা-ও অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য (এটা নবী (সা.)-এরই নির্দেশ) ঘর থেকে ঘর, মানুষ থেকে মানুষের কাছে যাওয়া। এর মাধ্যমে নিজে পরিশুদ্ধ হওয়া, সমাজ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।</p> <p> </p> <p><strong>উপসংহার</strong></p> <p>দাওয়াত ও তাবলিগের বর্তমান কাজটি নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে নবী (আ.)-রা এটা করেছেন। আমাদের নবী (সা.)ও এভাবেই মেহনত করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে জিন্দা করেছেন। হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দুর্বল হয়ে যাওয়া মেহনতের এই কাজটি সচল করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। সবই কোরআন-হাদিস মোতাবেক হচ্ছে, সবই হচ্ছে সাহাবা আজমাইনের নকশায়। যে কেউ এ ছয় সিফত ও পাঁচ কাজের সঙ্গে জড়িত হবেন, তাঁরা নবী (আ.) ও সাহাবা আজমাইনের কাজের সঙ্গেই নিজেকে জড়াবেন, তাঁদের মর্যাদাও আল্লাহ তাআলা সেভাবেই দেবেন। তাবলিগ জামাতের ওলামায়ে কিরাম বলেন, কাজটি করতে করতে করা, করতে করতে মরা। </p> <p> </p> <p><strong> লেখক : </strong>গবেষক ও কলামিস্ট</p> <p>drhannapp@yahoo.com</p>