<p>একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে। দলটি নির্বাচনের সময়ের গণতন্ত্রকে ‘নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত’ করবে বলে অঙ্গীকার করেছে। ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষ সংসদ প্রতিষ্ঠা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ বাতিল, বেকার ভাতা প্রদানসহ ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মান রক্ষায় ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন দলটির নেতারা।</p> <p>গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। ভোটের ১১ দিন আগে দেওয়া এই ইশতেহারে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কী কী করবে, তার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে দেখা গেছে, এর বেশির ভাগ দফার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের মিল রয়েছে।</p> <p>ইশতেহার ঘোষণা করে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে ঐকমত্য, সবার অন্তর্ভুক্তি ও <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/12 December/19-12-2018/Kalerkantho_18-12-19-24.jpg" style="float:left; margin:8px; width:300px" />প্রতিহিংসাহীনতা—এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’—সংবিধানের এই নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনায় যাবতীয় পদক্ষেপের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের মালিকদের মালিকানা সুদৃঢ় করা।</p> <p>৯ পৃষ্ঠার ইশতেহার তুলে ধরতে গিয়ে ফখরুল বলেন, ‘আজকের এই মুহূর্তে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নির্জন কারাবাস করছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না। আপনাদের একটি ভোট আমাদের নেত্রীর জীবনকে পুনরায় আলোয় উদ্ভাসিত করবে। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় জনগণের কাছে বিএনপির পক্ষে ভোট চাই।’</p> <p><strong>ইশতেহারে থাকা ১৯ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : </strong></p> <p><strong>রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য :</strong> রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ করা হবে।</p> <p><strong>সংসদে উচ্চকক্ষ :</strong> বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।</p> <p><strong>গণভোট পুনঃপ্রবর্তন ও ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন :</strong> পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল হওয়া গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।</p> <p><strong>জাতীয় কমিশন গঠন :</strong> প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে।</p> <p><strong>ন্যায়পাল নিয়োগ :</strong> প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হবে।</p> <p><strong>র‌্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন :</strong> র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। র‌্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করা হবে। এই ব্যাটালিয়ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। পেশাদারি বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুলিশের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প গৃহীত হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টরদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবসরে গেলেও তাঁদের রেশনিং সুবিধা প্রদান করা হবে।</p> <p><strong>নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টে :</strong> সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হবে।</p> <p><strong>মত প্রকাশের স্বাধীনতা :</strong> ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪সহ সব ধরনের কালাকানুন বাতিল করা হবে।</p> <p><strong>সরকারি চাকরির বয়সসীমা :</strong> দেশ রক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতীত শর্ত সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা থাকবে না।</p> <p><strong>বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির প্রতিবেদন প্রকাশ ও তদন্ত :</strong> বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত সব অনুসন্ধান রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে এসবের অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে।</p> <p><strong>জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ :</strong> জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডে যোগ্য, সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হবে।</p> <p><strong>ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত :</strong> অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা ও তদারকির ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হবে।</p> <p><strong>দেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থানে ওয়ার্ক পারমিট :</strong> দেশে কর্মরত সব বিদেশিকে ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় এনে মুদ্রাপাচার রোধ করা হবে।</p> <p><strong>বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ :</strong> বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন ও অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে।</p> <p><strong>বেকার ভাতা চালু :</strong> এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যেটাই আগে হবে শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। এদের যৌক্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। ২৫ বছর পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠন করা হবে।</p> <p><strong>মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত নাগরিক ঘোষণা :</strong> সব মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। মূল্যস্ফীতির নিরিখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বাড়ানো হবে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।</p> <p><strong>টাস্কফোর্স গঠন :</strong> রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের উচ্চ ব্যয়ের কারণ তদন্ত করে দেখা হবে।</p> <p><strong>দুস্থ, বিধবা ও অসচ্ছলদের বয়স্ক ভাতা :</strong> দুস্থ বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা ও অসহায় বয়স্কদের ভাতার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির নিরিখে বৃদ্ধি করা হবে। বেসরকারি ও স্বনিয়োজিত খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বার্ধক্যের দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি পেনশন ফান্ড গঠন করা হবে। গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হবে।</p> <p><strong>ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন :</strong> দল, মত, জাতি, ধর্ম-নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জাতিগোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এ লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।</p> <p><strong>কর্মসংস্থান :</strong> ইশতেহারে বলা হয়েছে, প্রথম তিন বছরে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দুই লাখ মানুষকে চাকরি প্রদান করা হবে। আর আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০ বছর মেয়াদি ঋণ চালু করা হবে।</p> <p><strong>শিক্ষা :</strong> বিদেশি ভাষা শিক্ষায় জোর দেওয়া হবে। স্বল্প সুদে শিক্ষাঋণ দেওয়া হবে। বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্যও ঋণ দেবে বিএনপি। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেবে। খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সম্মানী ভাতা দেবে। প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে ভূমিকা নেওয়া হবে। ভ্যাটবিরোধী, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সব মামলা তুলে নেওয়া হবে।</p> <p>ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে মূল মঞ্চে মির্জা ফখরুল ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।</p> <p>এ ছাড়া অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক আখতার হোসেন খান, অধ্যাপক ফিরোজা হোসেন, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম, অধ্যাপক আবদুল মান্নান মিয়া, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।</p> <p>বিএনপি নেতাদের মধ্যে সেলিমা রহমান, রুহুল আলম চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, তাবিথ আউয়াল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।</p>