<p>চট্টগ্রামে অবৈধ ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই অপরাধ সংঘটিত হলেও সেই তুলনায় অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারী গ্রেপ্তারের হার নেই। চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর অনেক সময়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলতে শোনা যায়, ‘অস্ত্রধারী পালিয়ে গেছে’ বা ‘অস্ত্রধারীদের খোঁজা হচ্ছে’ জাতীয় ভাষ্য। আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পরদিন কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার ও গ্রেপ্তারে পুলিশের সক্রিয়তা দেখা যায়, পরে তারা হাল ছেড়ে দেয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে বলছেন, চট্টগ্রামে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন স্মল আর্মস তথা ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার বেড়েছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র উঠছে উঠতি বয়সী কিশোর বা তরুণদের হাতেও। কিশোররাও এখন কথায় কথায় খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে। গত ১৬ জানুয়ারির আদদান ইসপার হত্যাকাণ্ড ও কয়েক দিন আগে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা কিশোর অপরাধ ও অস্ত্রের ব্যবহার দুটিই বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।</p> <p>ওই গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, এখন চট্টগ্রামে অন্তত পাঁচ হাজার অবৈধ ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তাই সময় এসেছে অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আসলে এখানে দুই রকমের সাঁড়াশি অভিযান হয়। একটা কাগুজে, একটা সত্যিকার অর্থের। সময় এসেছে কাগুজে সাঁড়াশি অভিযান বাদ দিয়ে একটি বাস্তবভিত্তিক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার। কারণ সন্ত্রাসীদের কোনো দল থাকতে পারে না।’</p> <p>চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অপরাধ শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে নগর পুলিশ মোট ৫৮৫টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩২১টি। গ্রেপ্তার হয়েছে ৪৮১ জন। সিএমপি ৫৮৫টি অস্ত্র উদ্ধারের কথা বললেও তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখানে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা নগণ্য—মাত্র ১২০টি। এর মধ্যে মধ্যে এলজিই আছে ৫২টি। বাকি মাত্র ২৫টি পিস্তল বা রিভলবার। অর্থাৎ সারা বছরে নগরের ১৬ থানা পুলিশ মাত্র ২৫টি ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।</p> <p>চট্টগ্রামে বিশেষ অভিযানের নামে কাগুজে চলে, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসেই দুই দফা বিশেষ অভিযান চালিয়েছে সিএমপি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার পর্যন্ত চার দিনের বিশেষ অভিযান চলেছে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেও বিশেষ অভিযান চলেছে। তাই অবৈধ ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকসহ অপরাধীদের ধরতে পুলিশ তৎপর।’ এক মাসেই দুই দফা বিশেষ অভিযান হলেও কোনো ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব হয়নি। তবে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। সাফল্য আসবেই।’</p> <p>ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে নগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন যে হারে রাজনৈতিক সন্ত্রাসী বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে। উঠতি সন্ত্রাসীদের কোমরে অস্ত্র আছে, এটা অনেকেই জানে। কিন্তু এই সন্ত্রাসীদের অনেকেই একটি দলের নাম ব্যবহার করছে। চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতাদের অনুগত এসব সন্ত্রাসী দলীয় পদ-পদবিও ব্যবহার করছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে, একটি সমাবেশে সন্ত্রাসীর কোমরে অস্ত্র দেখেছে পুলিশ। ধরতে গিয়েই ওই পুলিশ সদস্যকে থামতে হয়েছে, যদি অস্ত্রধারীকে ধরতে গিয়ে সমাবেশে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে ওই পুলিশ সদস্যকে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশও অসহায়।’</p> <p>নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনার (উত্তর) হাসান মো. শওকত আলী আরো বলেন, ‘নগর পুলিশের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। এখানে রাজনৈতিক সন্ত্রাসী বলে কোনো শব্দ নেই। সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পুলিশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা।’</p> <p>চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন—এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন চট্টগ্রামে মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিদেশি পিস্তল পাওয়া যাচ্ছে। এসব পিস্তলের গায়ে ‘মেড ইন ইউএসএস’ লেখা থাকলেও এগুলো মূলত ভারতের তৈরি।’ তিনি বলেন, ‘হাল সময়ে সন্ত্রাসীদের কাছে পয়েন্ট ২২ বোর, ৭.৬৫ এবং পয়েন্ট নাইন এমএম পিস্তল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অস্ত্রগুলো বহনে সুবিধা ও দামে কম হওয়ার কারণে সন্ত্রাসীরা এই সিরিজের অস্ত্রগুলো বেশি ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সময়ের চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোতে একই সিরিজের অস্ত্রগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।’ পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এসব ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র আসছে যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা সীমান্ত জেলা থেকে। পরিবহনে সহজ হওয়ায় সন্ত্রাসীরা পাচার করে চট্টগ্রামে এনে অস্ত্রগুলো বিক্রি করছে। অস্ত্রের দাম ২০ হাজার টাকায় নেমে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতে ধারণা করা যায়, অস্ত্রের জোগান বেড়েছে। তাই দাম কমেছে।’</p>