<p>তুরাগ নদের তীর এলাকায় গতকাল মহান আল্লাহর দরবারে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে লাখো কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হচ্ছিল আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। সমস্বরে তাদের এই আকুতিতে ইজতেমার বিশাল প্রান্তর, চারপাশের এলাকা, বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে এক আবেগপূর্ণ অপার্থিব পরিবেশ। মুসল্লিরা কেঁদে বুক ভাসায়, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে মুসলিম উম্মাহর সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। এবারের মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল জামে মসজিদের খতিব ও তাবলিগ জামাতের শুরা সদস্য হাফেজ মাওলানা জুবায়ের। প্রায় ৩৭ মিনিটব্যাপী মোনাজাতের প্রথম ১৪ মিনিট আরবিতে এবং পরের ২৩ মিনিট বাংলা ভাষায় পরিচালনা করেন তিনি। মোবাইল ফোনসেট, বেতার, ওয়্যারলেস সেট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের আরো লাখ লাখ মুসলমানের কাছে তা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই হাত তোলে ক্ষমাশীল পরওয়ারদিগারের দরবারে।</p> <p>কয়েক বছর ভারতের মাওলানা সা’দ কান্ধলভি বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন। এবার তাঁকে নিয়ে বিতর্ক ওঠায় তিনি ঢাকায় এসেও দিল্লি ফিরে যান। গতকালের মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আগামী শুক্রবার ১৯ জানুয়ারি শুরু হবে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব, শেষ হবে আগামী ২১ জানুয়ারি। ২০১৯ সালের ইজতেমা শুরু হবে ১১ জানুয়ারি।</p> <p>গতকাল রবিবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়ে শেষ হয় সোয়া ১১টায়। ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে গভীর ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে লাখো মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে অপার করুণা ও অশেষ রহমত কামনা করে। গতবারের বিশ্ব ইজতেমার চেয়ে এবার মুসল্লিদের উপস্থিতি কম ছিল। এ সত্ত্বেও কয়েক লাখ মুসল্লি ময়দানে উপস্থিত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ ১৭ জেলার মুসল্লি ছাড়াও ৯২টি দেশের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার তাবলিগ অনুসারী ইজতেমায় ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নেয়। মোনাজাতের আগে সকাল থেকে বাংলাদেশের মাওলানা প্রকৌশলী আনিসুর রহমান বয়ান করেন। এরপর ছয় উসুলের পাশাপাশি ঈমান ও আমলের ওপর হেদায়েতি বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। মুসল্লিরা আগ্রহভরে বয়ান শোনে।</p> <p>মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার ভোররাত থেকে হেঁটে টঙ্গী, কালীগঞ্জ, কোনাবাড়ী, সাভার, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা থেকে ইজতেমা ময়দানের দিকে ছুটতে থাকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীত তাদের কাছে ছিল তুচ্ছ বিষয়। ভোরের আগেই ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে যায়। মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকে ইজতেমার আশপাশের সড়কে অবস্থান নেয়। তারা ত্রিপল, পত্রিকা বিছিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। মানুষের এই ঢল আব্দুল্লাহপুর-উত্তরা ছাড়িয়ে যায়।</p> <p>এ ছাড়া মাঠ, পথ, বাড়ির ছাদ, তুরাগ নদের দুই তীর, নৌকা, বিভিন্ন যানবাহনসহ যে যেখানে পেরেছে মোনাজাতে শরিক হয়েছে। আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে গোনাহ থেকে মাফ চায় এবং মুসলমানদের সুখ ও শান্তি কামনা করে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মোনাজাতে অংশ নিয়ে আল্লাহর রহমত প্রত্যাশা করেছে।</p> <p><strong>সমাপনী ও হেদায়েতি বয়ান :</strong> আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়াতি বয়ানে মাওলানা আব্দুল মতিন বাংলা ভাষায় ঈমান, নামাজ, আমল, তালিম, এলেম, জিকির, দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরে বয়ান করেন। তিনি কোরআন তেলাওয়াত সর্বোত্তম জিকির বলে উল্লেখ করেন। মোনাজাতপূর্ব বয়ানে হাফেজ মাওলানা জুবায়ের মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, ঈমানের পরই বড় ফরজ নামাজ। নামাজ এমনভাবে আদায় করতে হবে, যেভাবে নবী করিম (সা.) আদায় করেছেন। নামাজের মধ্যে অলসতা মুনাফেকের স্বভাব।</p> <p><strong>ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা ও যানজট :</strong> মোনাজাত শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র জটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে তাদের দৌড়ঝাঁপ ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতর জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষকে ফিরতে দেখা যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় মুসল্লিদের কষ্টের সীমা ছিল না। অনেকে যেমন মাইলের পর মাইল হেঁটে মোনাজাতে শরিক হয়, তেমনি একইভাবে তাদের ফিরতে দেখা যায়। বিকেলে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।</p> <p><strong>মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা :</strong> গতকাল ইজতেমা ময়দান ও টঙ্গী থেকে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে লাইন পেলেও মুহূর্তেই কেটে যাচ্ছিল। মোবাইল ফোন কম্পানিগুলো নেটওয়ার্ক সুবিধা দিতে ইজতেমার আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার সংযোগ করেও এ সমস্যার পুরো সমাধান দিতে পারেনি।</p> <p><strong>পরিত্যক্ত জুতা ও পত্রিকার কাগজ :</strong> মোনাজাত শেষে হুড়াহুড়ি করে ইজতেমা ময়দান থেকে বের হতে গিয়ে অগণিত জুতা ও স্যান্ডেল ফেলেই খালি পায়ে মাঠ ত্যাগ করে অনেক মুসল্লি। ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের সড়কগুলোতে বিপুল পরিমাণ পত্রিকার কাগজ, জুতা ও স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। টোকাইরা এসব বস্তায় ভরে নিয়ে যায়।</p> <p><strong>চিকিৎসাসেবা :</strong> স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত গাজীপুর সদর উপজেলার সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক জানান, টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্ববধানে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে শনিবার বিকেল ৪টা থেকে রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত  ৯৪৬ জন চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগজনিত কারণে ১৬ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে এবং ১৯ জনকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের বিভিন্ন ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে আরো কয়েক হাজার মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।</p> <p><strong>অর্ধশতাধিক গ্রেপ্তার :</strong> গত ১৩ জানুয়ারি বিকেল থেকে ১৪ জানুয়ারি বিকেল পর্যন্ত ইজতেমাস্থলের আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তিকে পকেটমার-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। টঙ্গী মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্জ মো.  ফিরোজ তালুকদার এ তথ্য জানান।</p> <p><strong>মোনাজাতে মাইকের ব্যবস্থা ছিল পর্যাপ্ত :</strong> এ বছর রেডিও-টিভির জন্য ইজতেমা ময়দানের আশপাশ থেকে মোনাজাত প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না। মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের উদ্যোগে আব্দুুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেলস্টেশন, স্টেশন রোড ও আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা ছিল।</p> <p><strong>অজুর পানি ও পত্রিকা বিক্রি :</strong> গতকাল মোনাজাতের কিছু আগে ময়দানের আশপাশে প্রকাশ্যে ‘অজুর পানি’ বিক্রি করতে দেখা যায় এক শ্রেণির লোককে। প্রতি বদনা অজুর পানি ১০-১৫ টাকা, পত্রিকার পাতা ৫-১০ টাকা, প্লাস্টিকের বস্তা প্রতিটি ১৫-২০ টাকা এবং ছালার বস্তা প্রতিটি ২০-২৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।</p> <p><strong>অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ :</strong> সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়া উপেক্ষা করে পরিবহনগুলো  দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করার অভিযোগ করেছে মুসল্লিরা। মহাখালী থেকে টঙ্গী হয়ে কালীগঞ্জ এবং ভৈরব রোড, ময়মনসিংহ রোড, টাঙ্গাইল রোড, শেরপুর রোড, কিশোরগঞ্জ রোড এবং গাজীপুর রোডের যাত্রীবাহী বাসগুলো দ্বিগুণ হারে ভাড়া আদায় করেছে বলে তারা অভিযোগ করেছে।</p> <p><strong>২০১৯  সালের ইজতেমা শুরু ১১ জানুয়ারি :</strong> ইজতেমার মুরব্বি প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, ‘গত শুক্রবার তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব  ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।</p> <p><strong>আয়োজক কমিটি সন্তুষ্ট :</strong> দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের আসতে এবং ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের প্রতি ইজতেমা আয়োজক কমিটি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।</p>