<p>আট শতক জমির একাংশে একটা টিনশেড ঘর। পাশেই ছোট্ট মুদির দোকান। দোকানির বয়স সত্তর বছর ছুঁই ছুঁই। অতি সাধারণ দেখালেও এই মুদি দোকানির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি দেশের সেই সব উজ্জ্বল সাহসী মুখগুলোর একজন—যাঁদের ত্যাগ ও সাহসিকতার সুবাদে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। নাম তাঁর আলতাফ হোসেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর এককালীন যে অর্থ পেয়েছিলেন তা দিয়ে জেলা শহরের উপজেলা পাড়ায় টিনশেডের বাড়ি করেছেন। এখন চায়ের দোকানের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসা করে কোনো রকমে দিন কেটে যাচ্ছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।</p> <p>সম্প্রতি নীলফামারী পৌর শহরের উপজেলা পাড়ায় আলতাফ হোসেনের বাড়ি গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় বাড়ি লাগোয়া <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/December/06-12-2017/1/kalerkantho-06-12-2017-22.jpg" style="float:left; height:280px; margin:12px; width:162px" />তাঁর মুদির দোকানে। আলতাফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, একাত্তরে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করার গল্প, বলেছেন জীবনযুদ্ধের কথাও। আলতাফ হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালে চাইলে তিনিও এলাকার অনেকের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারতেন পাশের দেশ ভারতে। কিন্তু দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তিনি হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই অসুস্থ হয়ে পড়েন আলতাফের বাবা সেবার মামুদ। ছেলে দেশ স্বাধীন করে বীরের বেশে বাড়িতে ফিরে দেখেন বাবা আর নেই। রণাঙ্গনের স্মৃতি :  ‘তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। ভালো গোলরক্ষক হওয়ার সুবাদে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে চাকরি পেয়ে যাই সেনাবাহিনীতে। সৈয়দপুর সেনানিবাসে যোগ দিয়েছি, মাত্র এক মাস হয়েছে; যুদ্ধ শুরু হলো। পালিয়ে এসে অনেকের সঙ্গে যোগ দেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে। সে সময় আনসার বাহিনীর কমান্ডার লোকমান হোসেন, যাঁকে আমরা ডাকতাম লোকা দা, তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পাক হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ দল। আমি ছিলাম সে দলের সদস্য। আগেই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ থাকায় অস্ত্র হাতে এগিয়ে যাই সৈয়দপুর সেনানিবাস অভিযানে।’</p> <p>‘দিনটি ছিল মঙ্গলবার। শহর থেকে আমরা অগ্রসর হতে থাকি সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে। হাতে অস্ত্র দিল লোকো দা, ফজলার কমান্ডার (তাঁরা আনসার বাহিনীতে ছিলেন)। বর্তমান যেখানে উত্তরা ইপিজেড, ওই জায়গাটায় আমরা যখন পৌঁছেছি, জানলাম আমাদের অভিযানের খবর পেয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছুটে আসছে পাক হানাদার বাহিনী। সে যাত্রায় আমরা পিছু হটলেও থেমে থাকিনি।’</p> <p>‘ওই রাতে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে জেলার জলঢাকা উপজেলা, সেখান থেকে ভাদুর দরগা ও দেবীগঞ্জ হয়ে পৌঁছি পঞ্চগড় সীমান্তের চাউলহাটি ক্যাম্পে। আমরা ৬০ জনেরও বেশি ওই ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। এরপর ছয় নম্বর সেক্টরের অধীন চলে বিভিন্ন অপারেশন। আমার দলের কমান্ডার ছিলেন মাহবুব হোসেন।’</p> <p>‘একদিন বেরিয়ে ছিলাম অপারেশনে। পাক হানাদারদের ওমরখানা ক্যাম্প আক্রমণের লক্ষ্যে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি কুকুর এসে আমাদের আক্রমণ না করে বরং বিনয়ের সঙ্গে বারবার পথ রোধ করছিল। আমরা কুকুরটি অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। এর পরই কুকুরটি কমান্ডার মাহবুব হোসেনের পায়ের ওপর শুয়ে পড়ে। তখন কমান্ডার আমাদের আর্ডার দিলেন ‘পিনডাউন’! পিনডাউন হয়ে থাকা অবস্থায় দেখি আনুমানিক পাঁচ শ গজ দূর দিয়ে হানাদার বাহিনীর একটি দল এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর কমান্ডারের নির্দেশে আমরা হামলা চালালাম, পিছু হটল তারা। আরেকটি স্মৃতি মনে পড়ছে। আমরা কয়েকজন বসে কলার পাতায় ভাত খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের পাশেই বোমা পড়ল। পানিতে পড়ার কারণে কোনো ক্ষতি হয়নি কারো। সেই খাওয়া ছেড়ে চলল আমাদের পাল্টা আক্রমণ।’</p> <p>‘আরেক দিনের ঘটনা। এই স্মৃতিটি ভয়ের। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। পঞ্চগড়ের ভোজনপুরে নদীর ধারে আমাদের ক্যাম্প। বৃষ্টিতে নদী ভরে গিয়ে ক্যাম্পে কোমর পরিমাণ পানি। হঠাৎ সহযোদ্ধা শষী ভুষণ রায় চিৎকার দিয়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি তার গলায় সাপ পেঁচিয়ে আছে। ভয়ের মধ্যেও তাঁকে শান্ত থাকতে বললাম। পরে ধীরে ধীরে সাপটি নেমে গেল তার গলা থেকে।’</p> <p>‘যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় ঠাকুরগাঁও অভিযানে যাচ্ছিলাম। রেকি শেষ। রাতে আক্রমণ চালালাম। হঠাৎ গুলি এসে লাগল সহযোদ্ধা আফজাল হোসেনের গায়ে। তাঁকে পেছনে রেখে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম। এবার গুলিবিদ্ধ হলেন মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল। পর পর দুইজন আহত হওয়ায় দুজনকে নিয়ে আমরা আগের ক্যাম্পে ফিরে আসি।’</p> <p>বীর এই মুক্তিসেনা আরো বলেন, ‘রেকি করতাম। এরপর অপারেশনের জন্য ধাপে ধাপে অগ্রসর হতাম। আর বেশির ভাগ অপারেশন হতো রাতে। আমরা সেখান থেকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকি পঞ্চগড়ের দিকে। অমরখানা এলাকায় হানাদারদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে এগোতে থাকি ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে। এরপর দেশ স্বাধীন হলো, আমাদের নেওয়া হলো দিনাজপুর ক্যাম্পে। সেখানে অবস্থানকালে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হলেন কয়েকজন। এ দৃশ্য কোনো দিন ভোলার নয়।’</p> <p>জীবন সংগ্রাম : একাত্তর সালে দেশের জন্য লড়েছেন, পরেও সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল থেকে দেশ সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন। সেনাবাহিনীর হয়ে খেলেছেন দেশজুড়ে। জিতেছেন একাধিক শিরোপা। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাত থেকেও নিয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। সেই আলতাফ হোসেন ১৯৮৯ সালে অবসর নেওয়ার পর সাত ছেলেমেয়ের সংসারের হাল ধরতে শহরের মাধার মোড়ে দিলেন পানের দোকান! দূরত্বের কারণে যেতে-আসতে অসুবিধা হয় এই বয়সে। তাই এখন মুদির দোকান দিয়েছেন নিজ বাড়ির সঙ্গে। এখানেই বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ‘জীবনে খুব অভাব আছে, তার পরও আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। সরকারের ভাতা পাচ্ছি। নিজের দোকানের সামান্য আয় আছে। সবার ভরণপোষণ জোগাচ্ছি কোনোভাবে’—আলতাফ হোসেন বলছিলেন কালের কণ্ঠকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীতে চাকরির শুরুটা হয়েছিল ৮০ টাকা বেতনে। অবসর নেই ১১২০ টাকা বেতনে। কত টাকা পেনশন পাই এই হিসাব থেকেই বুঝে নিন। তবে আমার জীবনের বড় সন্তুষ্টি দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন একটাই প্রত্যাশা, দেশের মানুষ শান্তিতে থাক।’</p> <p>আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সামান্য পেনশন আর নিজের ওই দোকানের আয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছি। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে নূরন্নবী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরীর চাকরি করছে, মেজো ছেলে মো. শিপন ‘ভিডিও’র দোকানের কর্মচারী, আর ছোট ছেলে শুভ ইসলাম নবম শ্রেণিতে পড়ছে।’</p>