জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার জন্য মিয়ানমার দায়ী, তাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। শুধু ফেরত নিলেই হবে না, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মর্যাদার সঙ্গে নাগরিক হিসেবে যাতে তারা বৈষম্যহীনভাবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইউএনএইচসিআর প্রধানের সাফ কথা
নাগরিকত্ব দিয়ে ফেরত নিতে হবে রোহিঙ্গাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বচক্ষে দেখা পরিস্থিতি এবং সংকট সমাধানের উপায় সম্পর্কে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের বর্ণনা শুনে অধিবেশন ফেলে বাংলাদেশ সফরে আসেন ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশ সরকার ও এ দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় না। বরং কোনো শরণার্থী যাতে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সীমান্ত সিলগালা করে দেয়।
রোহিঙ্গাসহ কেউ সারা বিশ্বে যাতে শরণার্থী হতে বাধ্য না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে না পারা জাতিসংঘ বা ইউএনএইচসিআরের জন্য লজ্জার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে রেখেছে উল্লেখ করে গ্রান্ডি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের উত্স মিয়ানমারে, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে আমাকে এ কথাই বলেছেন, আমিও তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি একমত।
গ্রান্ডি বলেন, কফি আনান কমিশনের সুপারিশেই এই সংকটের সমাধানের কথা বলা আছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া ও রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলা আছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। ইউএনএইচসিআর চায়, দ্রুত আনান কমিশনের বাস্তবায়ন শুরু করবে মিয়ানমার।
গ্রান্ডি জানান, ইউএনএইচসিআর আগামী সপ্তাহে জেনেভায় বোর্ডসভার আয়োজন করছে, যেখানে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, খুবই স্বল্প সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমারে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে যেতে পারেননি। তবে শিগগিরই মিয়ানমার সফরে গিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করবেন।
সেফ জোন জটিল প্রক্রিয়া : জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে সেফ জোন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাব সম্পর্কে ইউএনএইচসিআরের অবস্থান জানতে চাইলে গ্রান্ডি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেফ জোন প্রতিষ্ঠা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো কিভাবে রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইন ও মিয়ানমারকে নিরাপদ রাখা হবে। সিরিয়ায় সেফ জোন হয়েছে। সেফ জোন করতে হলে সে দেশের সম্মতি লাগে। সংশ্লিষ্ট দেশ সম্মতি না দিলে সেফ জোন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হতে হয়। এটা বেশ জটিল প্রক্রিয়া। আমরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা চাই, সেটাই সর্বাগ্রে জরুরি।’
এমন কিছু করা উচিত যাতে নিজেরাই ফিরে যেতে চায় : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বর্বর হামলায় সেখানে চোখের সামনে স্বজনকে খুন হতে দেখেছে যারা, সেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে আর ফিরতে চাইবে কি না—জানতে চাইলে গ্রান্ডি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সব কিছু হারিয়েছে। অনেকে স্বজন হারিয়েছে, অনেকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তারা সেখানে ফিরতে আগ্রহী হবে না। তবে নির্যাতনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা এক দিনেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে না। তারা যাতে মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী হয়, সে জন্য কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ দীর্ঘ সময় ধরে নিশ্চিত করতে হবে মিয়ানমারকে। কেউ ফিরে যেতে না চাইলে, তাকে আমরা জোর করে পাঠাতে পারি না। সে জন্য আমাদের এমন কিছু করা উচিত, যাতে তারা নিজেরাই ফিরে যেতে চায়। আর ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে থাকতে পারে, সে জন্য সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে রাখাইনে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।’
আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করতে চাই : গ্রান্ডি বলেন, ‘এমনিতেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যেতে নিরাপদ অনুভব করবে না। এ জন্য মিয়ানমার সরকারকে অনেক কাজ করতে হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ বোধ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টির অনেক ফর্মুলা রয়েছে। সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা করা দরকার। এ দায়িত্ব মিয়ানমারের। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা মিয়ানমার কয়েকবার বলেছে। তারা একটি কমিটি গঠন করেছে। এটি বাস্তবায়নে আমরা কাজ করতে চাই।’
দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, এই দুই মাসে পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। রোহিঙ্গাদের যে ঢল নেমেছে, তা এই অঞ্চলে তো বটেই সম্ভবত সারা বিশ্বের মধ্যে এটি সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা শরণার্থী সমস্যা। কক্সবাজারে দুই দিন রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঘোরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, পাহাড় ও নদীর পাড়ে কম জায়গায় অনেক কষ্ট করে বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়েছে। কুতুপালং ও টেকনাফ থেকে আসা অনেকের কাছে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার বিবরণ শুনেছেন তিনি।
গ্রান্ডি বলেন, ‘যারা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা দেখেছে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিতে, পরিবারের সদস্যদের গুলি করতে অথবা ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে। নারী ও মেয়েদের ওপর পাশবিকতা হয়েছে। অনেক শরণার্থী বলেছে, তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। তবে এ জন্য তারা চায় সহিংসতার অবসান এবং অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা।’
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের এখনই ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে নয়—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রান্ডি বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিতে রাখাইন থেকে যারা এসেছে, তারা শরণার্থী। তারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা, সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য থেকে আসছে। তবে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তাদের নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে পারে। আমরা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের কাজে সরকারকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।’
অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে একটি চরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশকে কারিগরি সহায়তা দেওয়া হবে।
ছয় মাসে ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারেরও অনেক বেশি সহায়তা লাগবে : গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ ৩৬ হাজার উল্লেখ করে গ্রান্ডি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় আগামী ছয় মাসে ৭৭ মিলিয়ন ডলার লাগবে। এখন মনে হচ্ছে, এর চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ সহায়তা লাগবে।’ বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
গ্রান্ডি বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। সেখানে আরো চার লাখ ৩৬ হাজার যোগ হলো। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য অসাধারণ আতিথেয়তার কারণে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। কারণ, বাংলাদেশ ছোট দেশ, বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা, সম্পদও কম। তার মধ্যে এত বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া সত্যিই মহত্ত্ব্বের কাজ। অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ছোট ছোট ট্রাকে করে রোহিঙ্গাদের যা যা প্রয়োজন, তা সরবরাহ করছে। এসব দেখে আমি সত্যিই অভিভূত।’
মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ সত্ত্ব্বেও রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় উল্লেখ করে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার আরো বলেন, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। সুশৃঙ্খলভাবে খাদ্য বিতরণ চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। তা সত্ত্ব্বেও অনেক পরিবার ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। অনেক শিশু এই প্রথমবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না।
সম্পর্কিত খবর

মিরপুরে প্রথম টি-টোয়েন্টি আজ
লাহোরের ‘বদলা’ ঢাকায়
তরিকুল ইসলাম সজল

একটু পরপরই ভেসে আসছে ‘ওয়াচ ইট ওয়াচ ইট’ শব্দ। মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের মূল মাঠে সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। গতকাল সন্ধ্যায় কৃত্রিম আলোর নিচে সেন্ট্রাল উইকেটের দুই পাশের নেটে ব্যাট হাতে রীতিমতো তাণ্ডব চালালেন তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলীরা। বড় বড় ছক্কা হজমে এ দুই ব্যাটারের সামনে যেন বল ফেলার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না রিশাদ হোসেন, নাসুম আহমেদরা।
গতকাল সিরিজ-পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে মিরপুরের উইকেট নিয়ে একাধিকবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন দাসকে। সেসব কথার জবাব দেওয়ার আগে অবশ্য প্রথম ম্যাচের উইকেট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন লিটন। এরপর মিরপুরের কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতেও দেখা গেল তাঁকে।
পরিসংখ্যান অবশ্য বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা বলছে। এশিয়ান কাপের ম্যাচ বাদ দিলে টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি ২১ লড়াইয়ে মাত্র ২ জয় লিটনদের। এই দুটি জয় অবশ্য মিরপুরেই পেয়েছে বাংলাদেশ দল। তবে ২০১৬ সালের পর পাকিস্তানকে আর হারাতে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা, এই সময়ে হারে টানা ১২ ম্যাচ। সর্বশেষ সফরেও ৩-০ ব্যবধানে হারেন লিটনরা। এবার আক্ষেপ ঘোচাতে পারবে বাংলাদেশ? অধিনায়ক বললেন, যেকোনো দলকে হারানোর মতো মানসিকতা আমাদের আছে এবং আমরা সেই চেষ্টাই করব। কিন্তু নির্দিষ্ট এই দিনটাতে আপনাকে ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। তার মানে এই না যে ঘরের মাঠ বলেই আপনি ভালো খেলে জিতিয়ে দেবেন।’ তবে এসব ভেবে নিজেদের ওপর চাপ বাড়াতে চাচ্ছেন না লিটন, ‘না, কোনো অতিরিক্ত চাপ নেই। আমরা এসব রেকর্ডের দিকে মনোযোগ দিই না। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো ভালো ক্রিকেট খেলা এবং আমরা যে ধরনের ক্রিকেট খেলতে চাই, সেটাই খেলা। এই সিরিজেও আমরা একই বিষয়ে মনোযোগ দেব। আমরা প্রতিটি ম্যাচে ভালো ক্রিকেট খেলতে চাই এবং প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।’
মিরপুরের উঠান লিটনদের যেমন হাতের তালুর মতো চেনা, তেমনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলার সুবাদে পাকিস্তান দলের বেশ কয়েকজনও এখানকার কন্ডিশন সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছেন পাকিস্তানি অধিনায়ক, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই বিপিএলে খেলেছে, যা অবশ্যই একটি বড় সুবিধা। তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ আমাদের জন্য মূল্যবান। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছি।’ তবে বাংলাদেশও সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন লিটন, ‘দুই পক্ষই সুবিধা পাবে। ওরাও জানে আমাদের শক্তি, দুর্বলতার জায়গাও জানে। আমরাও তাদের সঙ্গে খেলি, শক্তি, দুর্বল জায়গাগুলো সম্পর্কে জানি। তো, আমার মনে হয় না এটা খুব সমস্যা হবে।’

গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৩০৬
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

ধীরে ধীরে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। কারফিউ শিথিল থাকায় আগের দিনের চেয়ে জন ও যান চলাচল বেশি ছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বুধবারের হামলা-সংঘর্ষে পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল পর্যন্ত চারটি মামলা করেছে। গতকাল শহরজুড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছিল।
এদিকে গত বুধবার থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩০৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নতুন গ্রেপ্তার করা হয় ১১৯ জনকে।
জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে আরো একটি মামলা করেছে পুলিশ।
এর আগে সন্ত্রাস দমন আইনে গোপালগঞ্জ সদর থানায় ৫৭৫ জন, কাশিয়ানী থানায় ৩৭০ জন এবং কোটালীপাড়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে এক হাজার ৬৫৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। সব মিলিয়ে আসামির সংখ্যা তিন হাজার চারজন।
পুলিশ জানায়, গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে চারটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা করা হয় সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায়। চারটি মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩৫৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় দুই হাজার ৬৫০ জনকে।
গোপালগঞ্জে গতকাল সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকে। এ অবস্থায় গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের সময়সীমা বাড়ায় জেলা প্রশাসন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ কামরুজ্জামান জানান, গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। তাই গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
গত বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ভণ্ডুল করতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন। দিনভর সংঘর্ষে প্রথমে চারজন এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেকজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে পাঁচজন নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

সালাহউদ্দিনকে নিয়ে এনসিপি নেতার বক্তব্যে উত্তাল কক্সবাজার
বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজার ও চকরিয়া প্রতিনিধি

কক্সবাজার জেলা শহরের শহীদ দৌলত ময়দানে এনসিপির জুলাই পদযাত্রার পথসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং কক্সবাজারের সন্তান সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর এক আপত্তিকর বক্তব্যে ফুঁসে উঠেছে কক্সবাজার। পাটওয়ারীর বক্তব্যের পরপরই শহরজুড়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। অবরোধ করা হয় সড়ক।
আকস্মিক এমন পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের কবল থেকে রেহাই পেতে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের পাহারায় পর্যটন শহর ছেড়ে বান্দরবানের পথে চকরিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় এনসিপির পদযাত্রা।
এর আগে দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার জেলা শহরের শহীদ দৌলত ময়দানের মঞ্চে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত গডফাদার ছিল শামীম ওসমান। এখন শুনছি, কক্সবাজারের নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে, মানুষের জায়গাজমি দখল করছে। আবার সে নাকি সংস্কার বোঝে না।
এমন বক্তব্য প্রদানের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। তখনই বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঘর থেকে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। এনসিপির নেতারা সমাবেশস্থল ত্যাগ করার পরপরই ক্ষুব্ধ বিএনপির নেতাকর্মীরা এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।
ওদিকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়াসহ সব উপজেলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এনসিপি নেতার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কক্সবাজার জেলা শহরে বিকেল থেকে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জাসাস, মহিলা দলসহ প্রায় সব সংগঠন একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল চলছিল।
এনসিপি আগেই কক্সবাজার থেকে পাঁচ জেলার উদ্দেশে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে কক্সবাজার শহরের দৌলত ময়দানমুখী পদযাত্রা শুরুর কথা থাকলেও তাদের কর্মসূচি শুরু হয় দুপুর ১টার পর। পথসভার মঞ্চে এনসিপি সভাপতি নাহিদ ইসলাম বলেন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিটি তৈরি করাসহ এই দুটি সংস্কারে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে জুলাই সনদ তৈরি সম্ভব।

ফিরে দেখা ২০ জুলাই ’২৪
কারফিউয়ের মধ্যেও সংঘর্ষ, নিহত ৩৭
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানির জেরে আগের দিন ১৯ জুলাই রাত ১২টায় দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। প্রথম দফায় এই কারফিউ ২০ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে। এরপর দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ফের কারফিউ শুরু হয়ে পরদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়।
এর মধ্যে থমথমে পরিবেশ আরো বাড়তে থাকে।
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে সরকার।
রাজধানীতে সহিংসতা ঠেকাতে এদিনও র্যাবের হেলিকপ্টার টহল অব্যাহত ছিল। বঙ্গভবন, গণভবন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, থানা, সারা দেশের কারাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল দেখা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে কারফিউ পাস নিয়ে জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বাইরে বের হন।
কারফিউয়ের মধ্যে রাজধানীর অলিগলিতে মানুষের আনাগোনা থাকলেও এদিন বেশির ভাগ প্রধান সড়ক ছিল প্রায় জনশূন্য। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকি ছিল। তবে এদিনও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, বনশ্রী, রামপুরা, মালিবাগ, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় সংঘর্ষ বেশি হয়।
সকাল থেকে রাজধানীর বাড্ডা, বনশ্রী, উত্তর ও মধ্য বাড্ডা এলাকায় অবস্থান নেয় কয়েক শ মানুষ। এর মধ্যে বনশ্রীতে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল বেশি। বিক্ষোভকারীরা সড়কে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ও আহত হন।
সংঘর্ষের মধ্যে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন দোকানের মালপত্র লুট হওয়ার খবরও পাওয়া যায় এদিন। মেরুল বাড্ডার হাতিরঝিল এলাকায় দোকানের লুট করা মালপত্র নিয়ে বিরোধে এক কিশোরের ছুরিকাঘাতে আরেক কিশোর নিহত হয়। এ ছাড়া আরেক কিশোর ছুরিকাঘাতে আহত হয়।
এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ওই ভবনে থাকা হাইওয়ে পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক মানুষ আটকা পড়ে। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ গিয়ে হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে। হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়াও ওই ভবনে থাকা হাসপাতাল, ব্যাংক, চায়নিজ রেস্টুরেন্টসহ অর্ধশতাধিক দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এদিন দুপুরে কারফিউ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্র ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্যই কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে কারফিউ শিথিল করা হবে।
আগের দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মন্ত্রিসভার তিন সদস্যের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সরকার এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সব দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে, যা আদালতে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং রায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিষয়টির একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা হবে।’
রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক
দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এদিন রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকের পরই অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউয়ের ঘোষণা আসে।
দুই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা
২০ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নির্বাহী আদেশে ২১ ও ২২ জুলাই সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ওই দুই দিন স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয় মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে। তবে জরুরি পরিষেবা কাজে নিয়োজিত কর্মীরা ছুটির আওতার বাইরে থাকবেন। সুপ্রিম কোর্টও বিচারিক আদালতগুলোতে দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করে।