<p>আগামী অর্থবছরে (২০১৭-১৮) ভোজ্য তেল, চিনি, লবণ থেকে শুরু করে আটা-ময়দা, সব ধরনের মসলা ও ফল, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির মাংস এবং জীবন রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ ওষুধে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে। প্রস্তাব অনুযায়ী আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটজাত তরল দুধ, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের সবজিও এ সুবিধা পাচ্ছে আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে। খেজুর, আঙুর, আপেল, আনারস, আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফলও পাচ্ছে একই সুবিধা। আদা, জিরা, লবঙ্গ, ধনিয়া, দারচিনি, এলাচসহ অন্যান্য মসলায় আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়েও ভ্যাট থাকছে না। বার্লি, ভুট্টা, ধান, সব ধরনের চাল, মুড়ি, গম ও গমের ময়দা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। ফল, সবজি, মসলা ও মাংসের ক্ষেত্রেও ভ্যাটমুক্ত সুবিধা মিলবে আড়াই কেজি পর্যন্ত। অর্থাৎ একসঙ্গে আড়াই কেজির বেশি এসব পণ্য না কিনলে ভ্যাট দিতে হবে না। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই নয়, ফুল ও ফুলের তোড়া, পাটজাত পণ্য এবং কৃষি খাতে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের বীজ, সেচ ও কীটনাশককে নতুন অর্থবছরে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ারও প্রস্তাব আসছে। এ ছাড়া ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত সরকারের ১০ প্রকল্প, হাইটেক পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে।</p> <p>নতুন ভ্যাট আইনের আওতায় নতুন অর্থবছরের বাজেটে যেসব পণ্য ও সেবাকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব থাকবে তার একটি তালিকা তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের সই করা ওই তালিকাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে গত ১৪ মে। তাতে এসব পণ্য ও সেবাকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য ও সেবাকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলে বাজারে নতুন করে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।</p> <p>সূত্র মতে, নতুন অর্থবছরে রোগী পরিবহনে ব্যবহৃত অ্যাম্বুল্যান্স সেবাকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে। ‘মানবিক’ কারণে চলতি অর্থবছরেও অ্যাম্বুল্যান্স সুবিধা ভ্যাটমুক্তি পেয়েছে। এ ছাড়া যাত্রী বহনে ব্যবহৃত ট্যাক্সি, বাস, মিনিবাস, লঞ্চ, স্টিমার ও ফেরি পরিবহন ব্যবস্থাকে ভ্যাটের বাইরে রাখা হচ্ছে। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন, পর্যটক বহনকারী যানবাহন, চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টার বাদে অন্যান্য এয়ারলাইনস এবং খাদ্যশস্য পরিবহনকারী পরিবহনসেবা বাদে অন্যান্য পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।</p> <p>প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা তালিকায় আগামী বাজেটে সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব আছে। প্রস্তাব মতে, সব ধরনের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা ভ্যাটের আওতার বাইরে থাকছে। এতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমবে। বর্তমানে চিকিৎসা ফির ওপর ভ্যাট আরোপ আছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বাদে সব ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসেবা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। শিশু পালন কার্যক্রম, বয়স্ক, অক্ষম, দরিদ্র বা যাদের স্থায়ী যত্ন আবশ্যক সে ধরনের অক্ষম লোকদের জন্য আবাসিক যত্নসেবা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ কার্যক্রমকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।</p> <p>প্রস্তাবিত তালিকায় জীবনরক্ষাকারী বেশ কিছু ওষুধ, হাসপাতালের বিছানার ভাড়া বা ফি ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার ওই তালিকায় আরো আছে বিভিন্ন ধরনের প্রভিটামিন ও ভিটামিন, ইনসুলিন ও তার লবণ, সব ধরনের জন্মনিরোধক উপকরণ, ভ্যাকসিন ফর হিউম্যান মেডিসিন, লিভার সিরোসিস, হেপাটাইটিস সি নিরাময়কারী, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও ভেষজ ওষুধ সামগ্রী, কিডনি ডায়ালিসিস সল্যুশন, ক্যান্সার নিরোধক ওষুধ, ম্যালেরিয়া নিরোধক, কুষ্ঠরোগ নিরোধক ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, সেরা টক্সিন ও কার্ডিওভাসকুলার ওষুধ, অ্যান্টি হেপাটিক, অ্যান্টি হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি, বায়োকেমিক ও সাইকোট্রপিক ওষুধ, অ্যানেসথেটিক, কিডনি রোগের ডায়ালিসিস ফ্লুইড এবং কিডনি সংযোজনের জন্য সাইক্লোসপরিন, ইনসুলিন, থ্যালাসেমিয়ার ওষুধ, ফাস্টএইড বক্স অ্যান্ড কিটস, বিভিন্ন ধরনের থেরাপি, যন্ত্র ও উপকরণসহ হিয়ারিং এইড, হার্ট বাল্ব, পেসমেকারে ব্যবহৃত উপকরণ।</p> <p>কৃষিকাজে ব্যবহৃত ধান বীজসহ সব ধরনের বীজ আমদানি ও সরবরাহ উভয় পর্যায়েই ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে। কৃষি খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সার, ইনসেকটিসাইড, ফাংগিসাইডস, হারবিসাইডস, এন্টিস্প্রাউটিং, প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেটর, ডিসইনফেকট্যান্টস ও অন্যান্য কাঁচামাল, সব ধরনের কীটনাশকও এ সুবিধার তালিকায় আছে। প্রস্তাব পাস হলে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সব ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানি ও সরবরাহ উভয় পর্যায়েই ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা ভোগ করবে। এ ছাড়া দেশীয় ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উৎপাদিত কোদাল, বেলচা, সেচ পাম্পের যন্ত্রাংশ, ফিশিং ট্রলার, হস্তচালিত টিউবওয়েল, ধান মাড়াইয়ের মেশিন, রাইস হলার, হুইট ক্র্যাশারকে সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কৃষি, উদ্যান, প্রাণিজ বা মৎস্য চাষের জন্য ব্যবহৃত ভূমি, কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত হিমাগার, ভেটেরিনারি মেডিসিনের ভ্যাকসিন, কৃষিতে সেচসেবা, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণ, খাদ্য শস্য-শাকসবজি মোড়কজাতকরণ, কৃষিবীজ সংরক্ষণ ও বিতরণ, মৎস্য ও জলজপ্রাণী আহরণ এবং সংরক্ষণকেও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে।</p> <p>প্রস্তাব মতে, আগামী অর্থবছরে নতুন কোনো ফ্ল্যাট বা আবাসিক ভবন কিনলে ভ্যাট দিতে হবে না। খালি জমি বিক্রির ওপরও নতুন আইনে কোনো ভ্যাট থাকছে না। বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হবে এমন আবাসিক ভবনের দখল ও বসবাসের অধিকারসংক্রান্ত কোনো লিজ, লাইসেন্স, ভাড়া ও অন্যবিধ সেবা ফি বা চার্জের ওপরও কোনো ভ্যাট থাকছে না। নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত প্রস্তুতকারক বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কোনো কারখানা ভাড়া করলে, সেই ভাড়ার ওপরও ভ্যাট দিতে হবে না। এ ছাড়া ১৫০ বর্গফুট আয়তনের কোনো স্থাপনা ভাড়ার ওপর ভ্যাট দিতে হবে না। ফলে সারা দেশে ছোট দোকান মালিককে দোকান ভাড়ার ওপর কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি সেবায় ব্যবহৃত কোনো স্থাপনার ভাড়া ভ্যাটমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে আগামী অর্থবছরে।</p> <p>প্রস্তাব অনুযায়ী দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত বড় প্রকল্পগুলোর নির্মাণ সংস্থা, পণ্য মেরামতকারী সংস্থা, কনসালট্যান্সি ফার্ম ও সুপারভাইজরি ফার্ম, পরিবহন ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, মানবসম্পদ সরবরাহ বা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান, বন্দর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স ও অন্যান্য সেবার ওপর কোনো ভ্যাট থাকছে না। বাংলাদেশ হাই টেক পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে জোগানদার (পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য বাদে) এবং বিদ্যুৎ বিতরণকারী (৮০ শতাংশ) ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা প্রাকৃতিক গ্যাসে (৮০ শতাংশ), ওয়াসা (৮০ শতাংশ), বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা (৮০ শতাংশ) এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য বাদে অন্য সব পণ্য ও সেবা জোগানদার শতভাগ ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাবে। পিপিপির আওতায় নির্মাণ সংস্থা, কনসালট্যান্সি ফার্ম ও সুপারভাইজরি ফার্ম, জোগানদার ও আইন পরামর্শক ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাবে।</p> <p>এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পরিবেশদূষণ রোধকারী কার্যক্রম, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয় এমন পুনর্বাসনমূলক কার্যক্রম, সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, জনস্বার্থে দেওয়া সব ধরনের দাতব্য ও বৈজ্ঞানিক সেবা এবং সব ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, স্থান ও স্থাপনাকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। পুস্তক, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও সরকারি গেজেট ছাপা ও প্রকাশ, শিল্পকর্ম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অপেশাদারি খেলাধুলা, অপেশাদারি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ভ্যাটের বাইরে থাকছে। লাইব্রেরি, সব ধরনের জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি, চিড়িয়াখান, বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রবেশ ফি ভ্যাটমুক্ত থাকছে।</p> <p>নতুন অর্থবছরে সাংবাদিক, অভিনেতা, গায়ক, বেতার ও টেলিভিশন পারফরমার, লেখক, পেশাদার ক্রীড়াবিদ, নৃত্যশিল্পী, অনুবাদক, জ্যোতির্বিদ, টাইপিস্ট, নিকাহ রেজিস্ট্রার, ঘটকালি প্রতিষ্ঠান, প্লাম্বার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, ও ইলেকট্রিক্যাল মিস্ত্রির দেওয়া সেবা ফি ভ্যাটমুক্ত রাখার প্রস্তাব থাকছে। তবে এসব পেশার লোক কোনো কনসালট্যান্সি ফার্ম, সুপারভাইজরি ফার্ম, জরিপ সংস্থা ও ইমিগ্রেশন উপদেষ্টা হিসেবে যেসব সেবা দেবেন, এর ওপর ভ্যাট আরোপ হবে।</p> <p>সূত্র মতে, হস্তচালিত লন্ড্রি, জনশক্তি রপ্তানিকারক সেবা, ঐতিহাসিক স্থানসহ পর্যটন স্থান ও স্থাপনা, ভাঙা কাচের টুকরা, প্লাস্টিক বর্জ্য, ভাঙ্গারি সরবরাহ (যেগুলো সাধারণত টোকাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়) এবং কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে তালিকায়।</p> <p>প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম অয়েল সরবরাহ এবং এলপিজি সিলিন্ডার, প্রাকৃতিক গ্যাস (উত্তোলন পর্যায় থেকে ডিস্ট্রিবিউটর পর্যন্ত) ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। আর ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার ও এসবের যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে। কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় ইলেকট্রনিক শিল্পকে সুবিধা দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।</p>