<p>রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। আয়তনে ১১৭ একর। আর সেই ভূখণ্ডে বসবাস ৬৪ হাজার পরিবারের। দরিদ্র শ্রেণির এই মানুষগুলোকে নিয়ে প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী খেলছে। এদের ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোর বেপরোয়া মিশনে ব্যস্ত গোষ্ঠীর সদস্যরা। ৯ সদস্যের সিন্ডিকেটটি সোয়া তিন লাখ মানুষকে জিম্মি করে মাসে চার কোটি টাকা ঘরে তুলছে। আর এই অবৈধ বাণিজ্য ঘিরে গত সাত বছরে অন্তত পাঁচজনের প্রাণ গেছে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/April/18-4-2017/1st-back/kalerkantho-18-04-2017-15.jpg" style="float:left; height:108px; margin:10px; width:95px" />সিন্ডিকেটটি পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিয়ে বস্তিবাসীর কাছ থেকে আদায় করছে দ্বিগুণের বেশি বিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কেউ দেখায় না। এ টাকার ভাগ নিয়মিত পৌঁছে যায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, পুলিশসহ নানা সংস্থার লোকজনের কাছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ব্যবহৃত হয় মাত্র। তাদের নাম সবাই জানলেও আড়ালে থাকেন গডফাদাররা। অবৈধ লাইন কাটতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজনকে। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেলতলা ও কড়াইল মৌজায় টিঅ্যান্ডটির ১১৭ একর জমি দখল করে ছয় হাজার ৪৩৬টি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ১০টি করে ঘর আছে। সব মিলিয়ে কড়াইল বস্তিতে ঘর আছে ৬৪ হাজার ৩৬০টি। প্রতিটি ঘরে একটি করে পরিবারের বাস। সেই হিসাবে ওই বস্তিতে থাকে তিন লাখ ২৫ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে ভোটার ৩৯ হাজার। </p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় কড়াইল বস্তি এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা মনজুল হক, গোলাম মস্তোফা, মমিন হোসেন, পারভেজ আলম, মিরাজ হোসেন, ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শহীদুল ইসলাম, টুটুল ইসলাম, ইউনিট আওয়ামী লীগ নেতা আরিফ হোসেন জোয়ার্দার ও ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আলমগীর হোসেন।</p> <p>৯ সদস্যের সিন্ডিকেটের শহীদুল ১৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। তবে তিনি বস্তি নিয়ন্ত্রণে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। কারা জড়িত, জানতে চাইলে তিনি কারো নাম বলতে রাজি হননি। এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন, ‘পানি, বিদ্যুৎ লাইন সরকারের অনুমতি নিয়েই চলছে। গ্যাসের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে অনুমোদন নেওয়ার।’ তিনি আরো বলেন, ‘বস্তিবাসী বাংলাদেশের নাগরিক। ভোটারও তারা। অন্যদের মতো তাদেরও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। আমরা বস্তিটির উন্নয়নে কাজ করছি।’</p> <p>কড়াইল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। জ্বলছে গ্যাসের চুলাও। বস্তিবাসী জানায়,  প্রতি মাসে ১৫০ টাকার বিনিময়ে একটি বাল্ব জ্বালাতে পারে তারা। একটি ফ্যানের জন্য লাগে ১৫০ টাকা। কোনো কিছু ব্যবহার না করলেও টাকা ঠিকই দিতে হয়। না দিলে সিন্ডিকেটের লোকজন লাইন কেটে দেয়। পরে সংযোগ পেতে অনেক ঝামেলা ও টাকা খরচ করতে হয়। ফলে বেশি বিল নিলেও তারা মুখ বুজে থাকে।</p> <p>এক হিসাবে দেখা গেছে, বস্তিবাসীর কাছ থেকে মাসে বিদ্যুতের বিল বাবদ নেওয়া হয় এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রতিটি গ্যাসের চুলার জন্য দিতে হয় ৬০০ টাকা করে। বস্তিতে ১২ হাজার চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চুলা থেকে প্রতি মাসে উঠছে ৭২ লাখ টাকা। পানির জন্য নেওয়া হয় মাসে এক কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে মাসে উঠছে চার কোটি টাকার মতো।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তিতে যাঁরা এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তাঁরা সরাসরি ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে টাকা তোলেন না। এ জন্য তাঁদের আলাদা লোক আছে। ফলে নেপথ্যের লোকদের সম্পর্কে জানে না বস্তির বেশির ভাগ মানুষ। আর যারা জানে, তারাও মুখ খোলার সাহস পায় না।</p> <p>বস্তিবাসী জানায়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির টাকা আদায় নিয়ে প্রায়ই গণ্ডগোল হয়। খুনের ঘটনাও ঘটে। গত সাত বছরে দুলাল, বশির, মোশারফসহ পাঁচজন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে হত্যা করা হয় দুলাল সর্দারকে। এর আগে বশির খুন হন। ২০১১ সালে নিহত হন মোশারফ নামে আরো একজন। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। আর এ কারণে খুনিরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় বস্তিতে। নিহতদের পরিবার মামলা দায়ের করলেও পুলিশ নির্বিকার। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও একই চিত্র ছিল বলে বস্তিবাসী জানিয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলে বস্তির সিন্ডিকেটও পক্ষ বদলে ফেলে।</p> <p>দুলাল সর্দারের পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায় ভয়ে তাঁর স্বজনরা বস্তি ছেড়ে চলে গেছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার মৃত সুলতান সর্দারের ছেলে দুলাল। ২০ বছর ধরে কড়াইল বস্তি এলাকায় মা, চার বোন এবং স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছিলেন তিনি। রহমান নামের এক ব্যক্তির হয়ে দুলাল মাসে সাত হাজার টাকা বেতনে বস্তিঘরের অবৈধ পানি ও বিদ্যুৎ বিল তোলার কাজ করতেন। এ টাকার ভাগ-বাটোয়ারার বিরোধে খুন হয়ে যান তিনি। </p> <p>স্থানীয় সূত্র জানায়, কড়াইল বস্তিতে খুনের ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার পায়নি কোনো পরিবারই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ ফরমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বনানী থানায় যোগ দেওয়ার পর কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। আগে কী হয়েছিল তা কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো বাণিজ্যের সঙ্গে পুুলিশের সম্পৃক্ততা নেই।’</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের ইমার্জেন্সি গ্যাস কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের ডিজিএম প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শহিদ সারওয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বস্তি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ কঠিন একটি বিষয়। কড়াইল বস্তির জন্য কিছু মিটার দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাসে একটি বাল্বের খরচ ১৫০ টাকা হতে পারে কি না, সেটা কোন ধরনের বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে তা না দেখে বলা যাবে না।’</p> <p>১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কড়াইল বস্তিটি নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা কিভাবে মেটানো যায় সে বিষয়ে আমরা মেয়র সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি।’ অবৈধ বাণিজ্য বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে থাকলে সেটি ভুয়া।’</p>
