<p>বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ৭৬টি মামলায় ১০৬ জন আসামিকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার অপরাধে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার রায়ে ঢাকার এক আদালতের পেশকার (বেঞ্চ সহকারী), পিয়ন ও তিন উমেদারকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে এই রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি দুর্বল তদন্তের কারণে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে রায়ে।</p> <p>সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন—ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতের পেশকার মো. মোসলেহ্ উদ্দিন ভূঁইয়া, পিয়ন শেখ মো. নাঈম এবং উমেদার মো. ইসমাইল, মো. আলমগীর ও মো. জাহাঙ্গীর। তাঁদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধির ৪৬৬ ধারায় সাত বছর ও ৪৭১ ধারায় সাত বছর মোট ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে উভয় সাজা একসঙ্গে কার্যকর হবে বিধায় প্রত্যেককে সাত বছর করে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। আসামিদের দুই ধারায় ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধ করা না হলে আরো এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।</p> <p>রায় ঘোষণার আগে আসামি মোসলেহ্ উদ্দিন, নাঈম ও ইসমাইলকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। রায়ের পর প্রত্যেককে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। রায়ে বলা হয়েছে, তাঁদের ইতিপূর্বে ভোগ করা কারাবাস দণ্ড থেকে বাদ যাবে। অন্য দুই আসামি আলমগীর ও জাহাঙ্গীর পলাতক থাকায় তাঁরা গ্রেপ্তার হওয়া বা আদালতে আত্মসমর্পণের পর থেকে রায় কার্যকর ধরা হবে।</p> <p>ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ৭৬টি মামলার ১০৬ আসামি কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ওই আদালতের বিচারকের সই জাল করে ভুয়া জামিননামা তৈরি করে কারাগারে পাঠানোর পর ওই সব আসামি মুক্তি পায়। পরবর্তী সময় ওই সব মামলার ধার্য তারিখে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির না করায় বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে আসে। বিষয়টি ওই বছর ১২ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর আদালত এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় হয়। পরে ওই জালিয়াতিতে জড়িত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়।</p> <p>পরদিন ১৩ জুলাই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনের পক্ষে নাজির ওবাইদুল হক আকন্দ বাদী হয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জামিননামা কারাগারে পাঠিয়ে আসামিদের মুক্তির ব্যবস্থা করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। তদন্তকালে জানা যায়, আরো দুটি মামলায় জব্দকৃত পাসপোর্ট মোটরসাইকেল মালিকের জিম্মায় দেওয়া হয় বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে।</p> <p>ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।</p> <p>রায়ের পর্যবেক্ষণ : রায়ে আদালত বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ কারণে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলো। বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া জামিননামা সৃজন করে আসামিদের মুক্তি দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে আদালত মনে করেন। এদের শাস্তি প্রদান না করা হলে পরবর্তী সময়ে আদালতের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হবে। এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই আদালত মনে করেন, শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটিকে কোনোক্রমেই কলঙ্কিত হতে দেওয়া যায় না। একই সঙ্গে যেকোনো মূল্যে আদালতের সম্মানকে খাটো করতে দেওয়া যায় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে আদালতের প্রতি মানুষের সীমাহীন আস্থাকে অটুট রাখতে হবে।</p> <p>আদালত রায়ে আরো বলেন, ভবিষ্যতে যাঁরা আদালতে নিয়োগ পাবেন তাঁরা এমন গর্হিত অপরাধ করতে সাহস পাবেন না যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়।</p> <p>তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : আদালত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ সম্পর্কে রায়ে বলেন, তাঁর মতো কর্মকর্তা দুদকে নিয়োজিত থাকলে ও ওই কর্মকর্তা তদন্তকাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকলে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তাই আদালত মনে করেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রায়ের কপি দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো প্রয়োজন।</p> <p>আদালত বলেন, একজন কর্মকর্তার কার্যকলাপের জন্য দুদকের মতো একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ওই সংস্থা ব্যবস্থা নেবে বলে আদালতের বিশ্বাস।</p> <p>তদন্ত কর্মকর্তা সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ সাক্ষ্য প্রদানকালে তাঁর স্বীকৃতমতেই তিনি মামলা তদন্তে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন। এই মামলার মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে তর্কিত ৭৬টি মামলায় জাল জামিননামা তৈরি করে ১০৬ জন আসামিকে বেআইনিভাবে মুক্ত করা হয়েছিল। দুটি মামলায় আলামত জিম্মায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব কাজে সংশ্লিষ্ট আসামিদের সঙ্গে কোন কোন ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল তা খুঁজে বের করা তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তা তিনি করেননি। তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি চরমভাবে অবহেলা করেছেন, উদাসীনতা দেখিয়েছেন ও ইচ্ছাকৃতভাবে আইনানুগ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত বিচারকের আদেশ জালিয়াতিতে আদালতের কর্মচারীরা ছাড়া আর কারা জড়িত ছিল তা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।</p> <p>রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন দুদকের বিশেষ পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। আর আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. খোরশেদ আলম, হাসানুজ্জামান সেলিম ও হারুনুর রশীদ।</p>