<p>অর্কেস্ট্রার গাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়েছে স্টকহোম কনসার্ট হলে। সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাফ তখন প্রবেশ করলেন। প্রায় এক হাজার ৩০০ জন বিশিষ্ট অতিথি দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁদের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন নোবেল বিজয়ীরাও। আসন গ্রহণের পর একে একে শুরু হয় নোবেলের বিভিন্ন বিভাগের পুরস্কার বিতরণ। প্রতিটি পুরস্কারের আগে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয় বিজয়ীদের কীর্তির কথা। এরপর তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নোবেল ক্রেস্ট, সম্মাননা সনদ ও প্রাইজমানির চেক। অনুষ্ঠানের এই প্রাথমিক পর্ব চাকচিক্যে সনাতনি ধাঁচের হলেও এর মাহাত্ম্যের কোনো কমতি ছিল না। তবে মূল আকর্ষণ ছিল রাজার নৈশভোজ, ওয়াইন টোস্ট, ব্যালে ডান্স ও আড্ডা।</p> <p>গতকাল শনিবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় এভাবেই অনুষ্ঠিত হলো ২০১৬ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এর কয়েক ঘণ্টা আগে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে এক অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া পুরস্কার।</p> <p>এ বছর নোবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বব ডিলানের অনুপস্থিতি অনুষ্ঠান আয়োজনকে বেশ মলিন করে। খোদ আমেরিকানদের বলতে শোনা যায়, ডিলানের এহেন আচরণ নতুন কিছু নয়। স্বভাবী কবি-শিল্পীর অগোছালো মনের খোঁজ কখনোই কারো পক্ষে রাখা সম্ভব হয়নি।</p> <p>পুরস্কার বিজয়ীরা এরপর একে একে আসেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য। বব ডিলানের অনুপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনায় নোবেল কমিটি। পুরস্কার বিতরণীর মাঝে মাঝে অর্কেস্ট্রার মোহনীয় সুরের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছিল মিলনায়তনজুড়ে। মহাসমারোহে হলেও অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল পূর্বনির্ধারিত, যার রিহার্সেলও দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে। সম্মানিত অতিথিদেরও লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের করণীয়গুলো। সব মিলিয়ে ঘড়ির পেন্ডুলামে ভর করা অনুষ্ঠানটি শেষ হয় প্রায় দেড় ঘণ্টার মধ্যে। অনুষ্ঠান শেষে অভ্যাগত অতিথিরা কিছুটা বিরতি নিয়ে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় জড়ো হতে থাকেন স্টকহোম সিটি হলে, যেখানে তাঁদের সম্মানে রাজকীয় নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। রাজা কার্ল গুস্তফ ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে অভ্যাগতদের শুভেচ্ছা জানান এবং টোস্ট করেন। খাবার পরিবেশনের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সুরের মূর্ছনা। এরপর সেই হলেরই অন্য প্রান্তে শুরু হয় ব্যালে ডান্স ও আড্ডা। গভীর রাতে শেষ হয় এই অনুষ্ঠান।</p> <p>নোবেলের সবচেয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী। এবারের বিজয়ী ৭৫ বছর বয়সী রক-কবি বব ডিলান নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে সশরীরে উপস্থিত থাকবেন না বলে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি নিশ্চিত করলেও কেন আসেননি, এর সুস্পষ্ট কোনো জবাব দেয়নি। সে কারণে এ বছরের নোবেল উৎসব খানিকটা মলিন বলে উল্লেখ করে খোদ নোবেল কমিটি।</p> <p>উল্লেখ্য, পুরস্কার ঘোষণার পর বব ডিলান নোবেল কমিটির সঙ্গে কথা বলতে এবং কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতেও অস্বীকার করেছিলেন। ডিলান পুরস্কার গ্রহণ করতে না এলেও নোবেল কমিটির বিশেষ অনুরোধে তিনি লিখিত পাঠান, যা অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়।</p> <p>শান্তিতে বিজয়ী সান্তোস বলেন—স্বর্গ থেকে আসা উপহার : অন্যদিকে নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটির দেওয়া চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস। গতকাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টায় নরওয়ের রাজধানী অসলোর সিটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পুরস্কার গ্রহণকালে সান্তোস এটিকে ‘স্বর্গ থেকে আসা উপহার’ বলে বর্ণনা করেন। এ সময় তিনি বলেন, শান্তির জন্য কখনো কখনো যুদ্ধের প্রয়োজন হয় এবং তা অনৈতিক কিছু নয়। সমালোচকরা তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনাও করেছেন।</p> <p>কলম্বিয়ায় প্রায় ৫০ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের লক্ষ্যে বামপন্থী গেরিলা যোদ্ধা ফার্ক বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করায় প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসকে এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে চুক্তির অন্য পক্ষ ফার্ক নেতাদের পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়নি। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করার মাত্র পাঁচ দিন আগে কলম্বিয়ার জনগণ গণভোটে শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করার পরও সান্তোসকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে সমালোচনার মুখে পড়ে নোবেল কমিটি। ‘সফলতাই সর্বক্ষেত্রে শেষ কথা নয়, বিনিয়োগকৃত প্রচেষ্টাই মুখ্য’—এই নীতির সফল প্রয়োগের কারণে প্রেসিডেন্ট সান্তোসকে দেওয়া হয় এই বিতর্কিত শান্তি পুরস্কার।</p> <p>গতকাল নরওয়ের রাজা হরাল্ডের হাত থেকে সান্তোষ এ পুরস্কার গ্রহণ করেন। তাঁর হাতে একটি মেডেল, সম্মাননা ও আট লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলারের প্রাইজ মানি তুলে দেওয়া হয়।</p> <p>সিনহুয়া জানায়, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে নরওয়ে নোবেল কমিটির পক্ষে কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান বেরিত রেইস অ্যান্ডারসন সান্তোসকে শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এ পুরস্কার প্রেসিডেন্ট সান্তোসকে এককভাবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে কলম্বিয়ার জনগণকেও সম্মান জানানো হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষ ও ব্যক্তি এ শান্তিপ্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছেন এবং তাঁরা আমাদের ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকার রাখেন। এর মধ্যে অক্লান্ত মধ্যস্থতাকারী, উদ্যোক্তা, কূটনীতিক, রাজনীতিক এবং অবশ্যই কলম্বিয়া সরকারের নেতা ও ফার্ক গেরিলারাও রয়েছেন।’</p> <p>পুরস্কার গ্রহণকালে বত্তৃদ্ধতায় হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে যুদ্ধেরও প্রয়োজন হয় এবং এটা অনৈতিক কিছু নয়। এরই মধ্যে তাঁর এ বক্তব্যে শান্তিকামী বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী সান্তোস বলেন, ‘আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। জীবনের এই বিস্ময়কর যাত্রাপথে আমাদের সবারই সার্বক্ষণিক যুদ্ধ করতে হয় বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধে জয়লাভই মুখ্য এবং যেকোনো কিছুর বিনিময়ে।’</p>