<p>অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন দিন দিন কঠোর হচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থার তালিকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশসহ নানা সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশিদের অর্থপাচার কমছে না। গেল বছর শুধু সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতেই এ দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫ কোটি আট লাখ ৫০ হাজার সুইস ফ্রাংক, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ চার হাজার ৪২৩ কোটি টাকা (১ সুইস ফ্রাংক সমান ৮০.৩ টাকা)। দেশ-বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা ২০১৫ সালে এই পরিমাণ নগদ অর্থ সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পাচার বেড়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। স্বর্ণসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে রাখে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা। তবে পাচার হওয়া অর্থের হিসাবে ওই সব ধাতুর মূল্য যোগ করা হয়নি।</p> <p>গতকাল সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দেশটির ব্যাংকগুলোর ২০১৫ সালের সামগ্রিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড, ২০১৫’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ দেশটিতে রাখা হয়েছে, তার বিশদ তথ্য রয়েছে।</p> <p>তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার অর্থপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গঠনসহ কঠোর প্রতিরোধমূলক আইন করছে। কিন্তু পাচারকারীদের কাউকে ধরে দৃশ্যমান শাস্তি দিতে পারেনি। এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭২ নম্বর থেকে দুই ধাপ অবনতি হয়ে এখন ১৭৪ নম্বরে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের সারিতে থাকা বিশ্বের সর্বনিম্ন এক-তৃতীয়াংশ দেশের মধ্যে। এখন হরতাল না হলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান।</p> <p>তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে নানাভাবে হরতাল ও ভাঙচুর হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। ফলে কেউই জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে স্বস্তিতে নেই। ফলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থপাচার বন্ধ করবে, এমন পরিবেশ দেশে নেই।  </p> <p>সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের পাচার করা ৫৫ কোটি আট লাখ ৫০ হাজার সুইস ফ্রাংকের মধ্যে ৫০ কোটি ২২ লাখ ৭৫ হাজার ব্যাংকিং চ্যানেলে গেছে। এর সঙ্গে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি কিংবা আমদানি-রপ্তানিতে পণ্যমূল্য কম-বেশি দেখিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা তা পাচার করেছে। ২০১৪ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৪২ কোটি ৪৩ লাখ ২৯ হাজার সুইস ফ্রাংক। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার বেড়েছে ১৮ শতাংশ।</p> <p>২০১৫ সালে পাচার হওয়া অর্থের মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে সরাসরি পাচার হয়েছে চার কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার সুইস ফ্রাংক। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল আট কোটি ১৬ লাখ ৩৩ হাজার সুইস ফ্রাংক। অর্থাৎ এ পর্যায়ে বাংলাদেশিদের পাচারের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪১ শতাংশ কমেছে।</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষক ড. মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো তাদের আইনকানুন কঠোর করছে। আবার অনেক দেশ সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে অর্থপাচারকারীদের তথ্য আদান-প্রদানের চুক্তি করছে। এসব কারণে নিবাসী ও অনিবাসী বাংলাদেশিরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অর্থ রাখা কমিয়ে দিতে পারে। তারা নিরাপদে অর্থ রাখার জন্য অন্য কোনো দেশ বেছে নিতে পারে। সে কারণে গ্রাহক পর্যায়ে পাচার কমে থাকতে পারে।</p> <p>আগের বছরের তুলনায় গত বছর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থপাচার বাড়লেও প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অন্যান্য দেশ থেকে পাচার কমেছে। ২০১৪ সালে দেশটির ২৬৬টি ব্যাংকে বিদেশিদের রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৮৯ বিলিয়ন সুইস ফ্রাংক। পরের বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৩০ বিলিয়ন।</p> <p>এশিয়ার বড় দুই অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারত থেকেও ২০১৪ সালের তুলনায় গত বছর সুইস ব্যাংকে পাচার কমেছে। চীন থেকে ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৮১০ কোটি ৮০ লাখ সুইস ফ্রাংক। গত বছর এর পরিমাণ নেমেছে ৭৩৫ কোটি ৭০ লাখে। ভারত থেকে গত বছর পাচার হয়েছে ১২০ কোটি ৬৭ লাখ সুইস ফ্রাংক। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৭৭ কোটি ৬১ লাখ।</p> <p>তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকা পাকিস্তান ও নেপাল থেকে আগের বছরের তুলনায় ২০১৫ সালে অর্থপাচার বেড়েছে। এর মধ্যে ভূমিকম্পবিধ্বস্ত নেপাল থেকে পাচার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ২০১৪ সালে দেশটি থেকে সুইস ব্যাংকে পাচার হয়েছে ১০ কোটি ২২ লাখ সুইস ফ্রাংক। গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩১ কোটি ৪৪ লাখ। পাকিস্তানিরা ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে পাচার করেছে ১২৩ কোটি ৬৫ লাখ সুইস ফ্রাংক। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৭ কোটি ৭১ লাখ ডলারে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান মূল প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে বিদেশে অর্থপাচার বেড়েছে। অর্থপাচারের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। গত ১০ বছরের হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যার ৮৮ শতাংশই হয়েছে আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা মূল্য ঘোষণা দিয়ে। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ২৭টি ব্যাংক হিসাবের কথা উল্লেখ রয়েছে।</p> <p>এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘পানামা পেপারসে যাঁদের নাম আছে তাঁদের কতজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হয়েছে, জানি না। আমদানি-রপ্তানির সময় মিথ্যা মূল্য ঘোষণা দিয়ে টাকা পাচার রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন বিদ্যমান উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। তাহলে নতুন মূলধনী যন্ত্রপাতি কেন আমদানি হচ্ছে, এ বিষয়ে এনবিআর কোনো অনুসন্ধান করেনি।’ তিনি বলেন, বিদেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কমাতে হলে দেশের মধ্যে একটি নিরাপত্তাবোধ এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আরেকটি বড় বিষয় হলো, অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেটা দৃশ্যমান হতে হবে।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, অর্থপাচারের মূল কারণ দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অপ্রতুলতা। দেশে যদি বিনিয়োগের পরিবেশ শতভাগ থাকত, তাহলে হয়তো পাচারের প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে অর্থপাচার হয়েছিল এর আগের বছরের থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। ওই সময় বিনিয়োগকারী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি অবশ্যই ছিল। এটা অর্থপাচার বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে। এর পরে ২০১৩ সালে অর্থপাচারের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক হানাহানি, সহিংসতা ছিল। এ কারণে অনেক মূলধন পাচার হয়েছিল। যদি বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করতে উৎসাহী কম হয়, তার দায় সরকারকে নিতে হবে। সরকারকেই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, কারা অর্থ পাচার করছে বাংলাদেশ ব্যাংক তা ভালো করেই জানে। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারে না। অনেকেই কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল বাড়ি বানাচ্ছে, ঘোড়ায় চড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ দেখেও দেখে না। পণ্যের খুচরা মূল্য নির্ধারণ না করে দিয়ে অনেককেই পয়সা বানানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সোনা চোরাচালান ধরা হয়; কিন্তু যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত তাঁদের ধরা হয় না। টাকা-পয়সা যেখানে থাকবে, সেখানে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা থাকবেন। এই ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে একটি অশুভ বন্ধন রয়েছে, যেটা দেশের ক্ষতি করছে। এই বন্ধনটাকে খুঁজে বের করে আনতে হবে।</p>