<p>চার-পাঁচ বছর আগেও সুন্দরবনের কটকায় বাঘ দেখা গেছে, এখন আর যায় না। এখন হয় বাঘ নেই অথবা বনের গভীরে সরে গেছে। সুন্দরবনে নিয়মিত ভ্রমণে যান, এমন একজন পরিবেশকর্মী হাসান মেহেদী এমনই মনে করছেন। তিনি বলছিলেন, সমগ্র সুন্দরবনের মধ্যে পশ্চিমের দিকে নোনার দাপট বেশি, পুবে কম অর্থাৎ কটকা একেবারে পুবে হওয়ায় এবং এখানে মিষ্টি পানির প্রবাহ থাকায় এখানে বাঘ বেশি থাকার কথা, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখানেই বাঘ কমে গেছে। তাহলে গোটা সুন্দরবনেই বাঘ কমবে, এটি খুবই স্বাভাবিক।</p> <p>নোনার দাপটে গোটা সুন্দরবনেরই প্রতিবেশব্যবস্থায় যে চিড় ধরেছে এমন কথা শোনা গেছে আগেই। এবার এক গবেষণায়ও সেটা জানা গেল, নোনার কারণে সুন্দরবনের পরিচয়বাহী বাঘের (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের বিচরণ এলাকা কমে আসছে।</p> <p>উপগ্রহের মাধ্যমে ছবি তুলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দপ্তরের একদল গবেষক এই সমীক্ষাটি করেছেন। গত বছরের ২১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘জার্নাল অব ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস’-এ এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।</p> <p>জার্নালে বলা হয়েছে, ম্যানগ্রোভ এই বনটির ওপর প্রায় ১৫ বছর নজরদারি চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। গবেষকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ার কারণে ভূমিক্ষয় হওয়ায় বনের এলাকা কমছে। আর লবণাক্ততা বাড়ছে।</p> <p>গবেষণাপত্রটিতে দাবি করা হয়েছে, অতিরিক্ত নোনা মাটিতে সুন্দরিগাছ আর বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। তার জায়গা নিয়েছে তুলনায় বেঁটে এক ধরনের গাছ, যা ভালোভাবে ডালপালা মেলে ধরতে পারে না। এর ফল হিসেবে সুন্দরবনের সমুদ্রের দিক ঘেঁষা বিস্তীর্ণ অংশে জঙ্গল ইতিমধ্যে পাতলা হয়ে গেছে।</p> <p>গবেষকদের দাবি, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের বাঘ প্রকল্পের মূল এলাকায় অতিরিক্ত নোনা মাটিতে মাথা তোলা ম্যানগ্রোভের নতুন প্রজাতির গাছগুলোতেও লবণের পরিমাণ অত্যধিক। ফলে তৃণভোজীরা তা মুখে তুলছে না। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের প্রধান তৃণভোজী প্রাণী হরিণ। এরা খাবার না পেয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। যে কারণে বাঘকেও সরে পড়তে হচ্ছে।</p> <p>সুন্দরবন ও বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বেডস) নির্বাহী প্রধান মাকসুদুর রহমান এই গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গবেষণাটি যদিও ভারতীয় সুন্দরবন অংশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, এই অভিমত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের জন্য প্রয়োজ্য নয়। এই অভিমত সমগ্র সুন্দরবনের জন্যই প্রযোজ্য। হতে পারে দু-একটি পর্যবেক্ষণ এদিক-ওদিক হচ্ছে। সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ এলাকা আমাদের দেশে, যা পূর্বাংশে; আর বাকি ৪০ শতাংশ এলাকা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, পশ্চিমাংশে।’</p> <p>লবণাক্ততা বা নোনা বাড়ার কারণ সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী এবং বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসায় নোনার আধিক্য ধরা পড়ে। উজানের নদীগুলোর পানি ভারত নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন নোনা পানির দাপট বেশি থাকে। উপরন্তু পশ্চিম অংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বেড়েছে।’</p> <p>পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিলিমিটার করে বাড়ছে। এতে সমুদ্রের নোনা পানি বেশি বেশি করে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে প্রবেশ করছে, বাড়িয়ে তুলছে নোনার মাত্রা। পরিণতিতে থমকে যাচ্ছে সুন্দরীসহ কিছু ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের বংশবিস্তার।</p> <p>জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতকের শেষে সাগরের পানির স্তর তিন ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে মাটিতে নোনার বিষ আরো বাড়বে, আর পাতলা হবে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। আর সুন্দরবনের দ্বীপগুলোতে অবাধে সেই নোনা জল প্রবেশ করবে। আবার মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়লে বাইনজাতীয় গাছের সংখ্যা বাড়ে। তার শ্বাসমূল ঘন হওয়ায় বাঘের শিকার ধরতে অসুবিধা হয়।</p> <p>ভারতীয় সুন্দরবনের প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য গবেষক দলটি হায়দরাবাদের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টারের মাধ্যমে বছরের পর বছর বনের ছবি সংগ্রহ করেছে। পুরনো ও নতুন বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভের নমুনা পরীক্ষা করেছে। তাদের গবেষণাপত্র বলছে, গত ১৫ বছরে ভারতীয় সুন্দরবনে বাঘ প্রকল্পের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ঘনত্ব কমেছে ২২ শতাংশ। দক্ষিণে ১৪ শতাংশ। এর মানে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে বনের ক্ষয় বেশি। গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অতনু কুমার রাহা।</p> <p>সুন্দরবনের পূর্বাংশে উজানের মিষ্টি পানি যা সামান্য আসে তা বলেশ্বর দিয়ে। এই বলেশ্বরের পারে কটকা অভয়াশ্রম। সূর্যাস্ত দেখার জন্য স্থানটি মনোরম। পরিবেশটি শান্ত থাকলে এখানেই দেখা মেলে চিত্রা হরিণের। এর পাশেই টাইগার টিলা। এখানে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। সমগ্র সুন্দরবনের মধ্যে এটি উঁচু জায়গা। বনের অন্যান্য অঞ্চল জোয়ারের পানিতে সয়লাব হলেও এই জায়গাটিতে পানি ওঠে না। জোয়ার ও নোনার দাপটে বনের পশ্চিম অংশ বেশি আক্রান্ত বলে সেখানে বাঘের সংখ্যা কম। পূর্ব সুন্দরবনে উঁচু জায়গা এবং নোনার পরিমাণ কম হওয়ায় এখানে বাঘের সংখ্যাও বেশি। আবার আকর্ষণীয় বলে পর্যটকদের আনাগোনাও বেশি। ট্যুর অপারেটররাও কটকাকে ঘিরে তাদের যাত্রাসূচি ঠিক করে।</p> <p>প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে বাঘের দেখা মিলেছে মাত্র ৩৮টি। বনের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় এই ক্যামেরা বসানো হয়। খাল জরিপ ও বাঘের বসতি বিবেচনা করে বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ থাকতে পারে ৬২ থেকে ১৩২টি। গড় হিসাবে এই সংখ্যা ১০৬।</p> <p> </p>