<p>রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ছোটখাটো একটি প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বসেন ঢাকার একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা একজন চিকিৎসক। জানালেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু টেকেননি। বারডেম ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন, চাকরি জোটেনি। নামিদামি অন্য হাসপাতালগুলোতে ঘুরেও লাভ হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে এ হাসপাতালে চাকরি নিয়েছেন, বেতন মাসে মোটে ১২ হাজার টাকা।</p> <p>কারণ জানতে চাইলে হতাশা নিয়ে কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘অনেক শখ ছিল ডাক্তারি পড়ার। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা ভালো কোনো বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে পারিনি। শখ পূরণ করতে সাধারণ মানের একটি কলেজেই ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু তার মাসুল গুনছি এখন। ভালো কোথাও চাকরিই পাচ্ছি না। প্রাইভেট চেম্বারেও তেমন একটা রোগী পাই না। রোগীরাও এখন ডাক্তারের ব্যাকগ্রাউন্ড খোঁজ নিয়ে তারপরই চেম্বারে আসে।’</p> <p>মেয়েকে সাধারণ মানের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে এখন হতাশায় পুড়ছেন নারায়ণগঞ্জের এক অভিভাবক। তিনি বললেন, ‘আমার বংশে কেউ ডাক্তার নাই। মেয়েটিকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন ছিল। ডাক্তারের আলাদা একটা মর্যাদা আছে, তা ছাড়া কোনোমতে পাস করলেই কোথাও চাকরি হোক বা না হোক অন্তত প্রাইভেট চেম্বার দিয়ে বসলেও টাকার অভাব হয় না। কিন্তু এখন তো দেখছি সিদ্ধান্তটা ভুলই হয়ে গেছে। ভালো মেডিক্যাল থেকে পাস না করলে ডাক্তারদের চাকরি হচ্ছে না। তাঁদের চেম্বারও তো দেখি খাঁ খাঁ করে।’</p> <p>দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ১০০। এর মধ্যে সরকারি ৩৬টি, বেসরকারি ৬৪টি। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ডেন্টাল কলেজ ও ইনস্টিটিউট আছে ৩৩টি। এর মধ্যে সরকারি ৯টি, বেসরকারি ২৪টি। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ডাক্তারি পাস করে বের হচ্ছেন। কিন্তু পাসের পর তাঁদের অনেকের মুখের হাসিই মিলিয়ে যাচ্ছে। কারণ সরকারি হাসপাতালে চাকরির জন্য বিসিএসে বসতে হচ্ছে। অনেকেই সে পরীক্ষার বাধা উতরাতে পারছেন না। আর নামিদামি হাসপাতালগুলো প্রথমেই বেছে নেয় সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস</p> <p>করা ডাক্তারদের। বেসরকারির মধ্যে প্রথম সারির ১০-১২টি বাদে বাকিগুলো থেকে পাস করা ডাক্তারদের চাকরি দিতে আগ্রহী নয় তারা। কারণ হিসেবে তারা বলছে, এসব মেডিক্যালে যথেষ্ট পড়াশোনা হয় না। সেগুলো থেকে পাস করা ডাক্তারদের মানও ততটা ভালো নয়। হাসপাতালের সুনাম রক্ষার্থেই তাঁদের চাকরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।</p> <p>সাধারণ মানের বেসরকারি মেডিক্যাল থেকে পাস এসব ডাক্তারের শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হচ্ছে নিম্নমানের হাসপাতালগুলোতে। এতে একদিকে তাঁরা নিজেরাও যেমন বিড়ম্বনায় পড়ছেন, তেমনি তাঁদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।</p> <p>পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ডাক্তারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সর্বশেষ হিসাব (৫ অক্টোবর, ২০১৫) অনুযায়ী, দেশে সরকার অনুমোদিত অ্যালোপেথিক ঘরানার চিকিৎসকের সংখ্যা ৮০,৫৮০ জন। ২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার করে মোট পাঁচ বছরে নিবন্ধন নিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার চিকিৎসক। আর গত পাঁচ বছরে যাঁরা এমবিবিএস ও বিডিএস শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয়েছেন তাঁদের সংখ্যা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিবছর ১০ হাজার হিসাবে পৌঁছে যাবে ৫০ হাজারে। অর্থাৎ বর্তমান ৭২ হাজারের সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরেই আরো কমপক্ষে ৫০ হাজার ডাক্তার যুক্ত হয়ে দেশে মোট ডাক্তারের সংখ্যা সোয়া লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের চেয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তারের সংখ্যা থাকবে দ্বিগুণেরও বেশি, যাঁদের বড় অংশই নিম্নমানের মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা।</p> <p>তাই চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসক তৈরির প্রক্রিয়ায় গুণগত মান ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে খোদ চিকিৎসা খাতেই। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে থাকা বেশির ভাগ নিম্নমানের মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তারদের ভালো কোথাও চাকরির সুযোগ না মেলায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ডাক্তাররা শিগগিরই দেশের চিকিৎসা খাতের বোঝা হয়ে দেখা দেবেন, যা সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে সরকারের জন্য। তা ছাড়া রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভুল বা অপচিকিৎসার ঝুঁকিও বহুগুণ বাড়বে।</p> <p>বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে ৬৪টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ১০-১২টি বাদে বাকিগুলোর শিক্ষার গুণগত মান সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো শিক্ষক বা শিক্ষার পরিবেশ-উপকরণও নেই।</p> <p>চিকিৎসকদের পেশাগত সর্বজনীন সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংখ্যার দিক থেকে ডাক্তারের সংকট কাটানোর দৌড়ে নেমে আমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি। চিকিৎসা শিক্ষার মানের সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে কম্প্রোমাইজ (আপস) করে ফেলছি। বেসরকারি বেশির ভাগ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজেই মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। এসব জায়গা থেকে যে ডাক্তাররা বেরিয়ে আসবে তারা সরকার ও আমাদের পেশার জন্য বোঝা ছাড়া কিছু হবে না।’</p> <p>এই চিকিৎসক নেতা আরো বলেন, ‘চিকিৎসা শিক্ষার মান ধরে রাখতে প্রচণ্ড চেষ্টা করছি; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। অনেক মেডিক্যাল কলেজ আছে, যেখানে শিক্ষার্থী অনুপাতে রোগীর বেড কিংবা শিক্ষক নেই। এসব কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তাররা বিসিএস কিংবা ভালো কোনো লড়াইয়ে টিকতেও পারে না। তবে কয়েকটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভালো পড়াশোনা হয়। সেখান থেকে বের হওয়া ডাক্তাররা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পায়।’</p> <p>জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, ‘মানসম্পন্ন ডাক্তার তৈরির জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক ও চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা। এ জন্য চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, বিএমডিসির নিয়ন্ত্রণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ, মেডিক্যাল কলেজের নিয়ন্ত্রণ—সব কিছুকে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই একজন ডাক্তার যেন এক জায়গা থেকেই সব কিছু পেতে পারে। এ ছাড়া মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বাড়ানো দরকার।’</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু কিছু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ রাজনৈতিক প্রভাব বা টাকার জোরে উপযুক্ত মানদণ্ড না মেনেও অনুমোদন পেয়ে যায়। যাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষার্থী ভর্তির নামে টাকা কামানো। এ ধরনের কিছু ব্যবসাভিত্তিক প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের দুর্নাম সব প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের ওপর পড়ছে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে কোয়ান্টিটি (পরিমাণ) না বাড়িয়ে বরং কোয়ালিটিতে (মান) জোর দেওয়া হবে।</p> <p>তবে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অভিন্ন হয়ে থাকে। কোর্স শেষে সরকারি-বেসরকারি কলেজে পাসের হারেও খুবই সামান্য ব্যবধান থাকে। তাই সরকারি মেডিক্যাল কলেজের চেয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তারের মান খারাপ হবে, এটা বলা মোটেই ঠিক নয়। বেসরকারিতে শিক্ষকের সংকট থাকলেও মানগত দিক থেকে সবাই খুবই দক্ষ ও মেধাবী। তবে এটা স্বীকার করা যায় যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ক্লিনিক্যাল দক্ষতা বা মেধার কাছে বেসরকারি পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে থাকে কেবল রোগীর দিক বিবেচনায়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে সংখ্যক রোগী থাকে তা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেশির ভাগেই নেই।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় নামিদামি প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তারদের সুযোগ দিতে চায় না, তারাও সরকারি বা বেশি নামিদামি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদেরই সুযোগ দেয়। এমন আচরণ পরিহার করা উচিত।’</p> <p>স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগ থেকে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্যে দেখা যায়, বিএমডিসি থেকে লাইসেন্সধারী ডাক্তারদের ৬০.২৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং ৩৯.৭৩ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে) কাজ করেন। ওই সূত্র অনুসারে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে সারা দেশে ডাক্তারের অনুমোদিত পদ সংখ্যা মাত্র ২৩ হাজার ৬৩৬ (গত বছরের জুন পর্যন্ত)। এর মধ্যে আবার এক হাজার ৭৯৬টি পদই শূন্য পড়ে আছে। ফলে কর্মরত ডাক্তার আছেন মোটে ২১ হাজার ৮৪০ জন। যাঁদের মধ্যে পুরুষ ডাক্তার ১৫ হাজার ৩৮৭ জন, নারী ডাক্তার ছয় হাজার ৪৫৩ জন। গত তিন বছরে পদ সৃষ্টি হয়েছে খুবই ধীরগতিতে।</p> <p>জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেবল ডাক্তার তৈরি করলেই হবে না, তাঁদের নিয়োগের পরিধিও বাড়াতে হবে। পদ বাড়াতে হবে। মাঠ পর্যায়ে থাকার মতো তাঁদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রাইভেট সেক্টর থেকে পাস করা ডাক্তারদের মেধা অনুসারে চাকরির সুযোগও তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে কম মেধাবীদের মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তাঁরা নিজেদের মতো করে চিকিৎসার নামে মানুষকে প্রতারিত করার সুযোগ পাবেন। মানুষ তাঁদের মাধ্যমে বিপদে পড়বে।</p> <p>বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষার আরো পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ডাক্তারদের শিক্ষিত করা না গেলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি ১০০ মেডিক্যাল কলেজ আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ অনুপাতে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের চিকিৎসক আছে কি না?</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডাক্তারের মধ্যে মানগত কোনো পার্থক্য থাকার কথা নয়। সব ডাক্তারের কাছ থেকে রোগীরা একই মানের সেবা পাবে, এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজই সেই মানদণ্ড অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমরা বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে মনিটরিংয়ের (নজরদারির) আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি।’</p>