ঢাকা, রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫
৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৪ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫
৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৪ মহররম ১৪৪৭

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো

নির্মলেন্দু গুণ
নির্মলেন্দু গুণ
শেয়ার
স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে

লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে

ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-

'কখন আসবে কবি?' 'কখন আসবে কবি?'

 

এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,

এই বৃক্ষে- ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,

এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।

তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?

তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,

ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে

হয়েছে উদ্যত কালো হাত।

তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ

কবির বিরুদ্ধে কবি,

মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,

বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,

উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,

মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...।

 

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,

শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি

একদিন সব জানতে পারবে,- আমি তোমাদের কথা ভেবে

লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।

সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর;

না পার্ক না ফুলের বাগান,- এসবের কিছুই ছিল না,

শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত

ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।

আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশে ছিল

এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।

 

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল

কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে

এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে

এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে

এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,

ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।

একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।

'কখন আসবে কবি?' 'কখন আসবে কবি?'

 

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা,

জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- ;

কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনলেন তাঁর

অমর কবিতাখানি:

'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'

সেই থেকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।

 

'স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো' কবিতার প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি মঞ্চের সামনে থেকে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি একটি পত্রিকার জন্য রিপোর্ট লিখতে সেখানে গিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইতিহাসবিকৃত হওয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাকে এমনভাবে নিয়ে আসা হয়, যেন জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন! তখন আগামী প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য কবিতাটি লেখার তাগিদ অনুভব করি।

আসলে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল একটি কবিতা।

এই ভাষণটি কাব্যসমৃদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সাপ্তাহিক 'টাইমস' পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর 'পয়েট অব পলিটিকস' শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল। এমনকি মার্কিনরাও এই ভাষণ স্টাডি করে তার মধ্যে কবিতার সন্ধান পেয়েছিল। ভাষণটি স্বয়ং একটি কবিতা হওয়ায় তা নিয়ে কবিরা খুব বেশি কোনো কবিতা লেখেননি। এই ভাষণে ১০৩টি লাইন আছে। ১৯ মিনিট দৈর্ঘ্য। ভাষণটি তিনি এমন চমৎকারভাবে দিয়েছিলেন, প্রথমেই 'ভায়েরা আমার' বলে যে সম্বোধন করলেন, মনে হলো, যেন হাজার বছরের বাঙালির যে ভালোবাসার তৃষ্ণা এবং যে প্রত্যয় নির্ভরতা, যার স্বপ্ন দেখেছে সে, সেই নেতা এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। ১০ লাখ লোক একসঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল। সব মানুষ যেন আনন্দে উত্তেজনায় একাকার। তাদের নেতার উপস্থিতিতে নিজেদের শক্তির প্রদর্শন করছিল তারা। এটি একটি অবিস্মরণীয় ভাষণ।

শ্রুতলিখন : মাহমুদ শাওন

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ