<p>স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া মানেই জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া। এটি একটি জরুরি স্বাস্থ্যগত অবস্থা, যা যে কারো হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা নিলে বরং মস্তিষ্কের ক্ষতি ও স্ট্রোকসংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অন্যথায় রোগীর মৃত্যুও ঘটে। লিখেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন  বিভাগের কনসালটেন্ট<strong> ডা</strong><strong>. </strong><strong>এস এম হাসান শাহরিয়ার</strong></p> <p> </p> <p>অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে স্ট্রোকে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। তবে জীবনযাপন-পদ্ধতি ও আচরণগত পরিবর্তন এনে ৮০ শতাংশ স্ট্রোকের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।</p> <p> </p> <p><strong>স্ট্রোক কী, কেন হয়?</strong></p> <p>মস্তিষ্কে হঠাৎ রক্ত প্রবাহের ঘাটতিই হলো স্ট্রোক। রক্তনালির ভেতরের অংশে কোলেস্টেরল, চর্বি, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে এবং রক্তনালির স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে মস্তিষ্কের যেকোনো অংশে রক্ত সরবরাহ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। দেহের রক্তের মাত্র ২ শতাংশ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল। অক্সিজেন বা শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে দ্রুত এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আবার রক্ত সরবরাহ বা পরিবহনের সময় যদি কোনো কারণে ব্যাঘাত ঘটে বা নালিকাগুলো ফেটে যায় তখন স্ট্রোক হয়। এ সময় যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হয়, তা না হলে কোষগুলো শরীরের যেই অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ওই অংশগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে অথবা রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।</p> <p>একজন সুস্থ মানুষ পথ চলতে চলতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন কিংবা খেতে খেতে, বাথরুমে অথবা নামাজ পড়তে পড়তে একদিকে ঢলে পড়লেন বা অজ্ঞান হয়ে গেলেন—এ সবই স্ট্রোকের লক্ষণ। এটা যে কারো ক্ষেত্রে যেকোনো সময় হতে পারে, তবে ৪০ বছর বয়সের পর এর ঝুঁকি বেশি।</p> <p> </p> <p><strong>স্ট্রোকের ধরন</strong></p> <p>মূলত দুই ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। ইস্কেমিক স্ট্রোক, হেমোরেজিক স্ট্রোক। এ ছাড়াও আরেক ধরনের মিনি স্ট্রোক রয়েছে, যাকে ট্রানজিয়েন্ট ইসেকমিক আ্যাাটাক (টিআইএ) বলে।</p> <p><strong>ইস্কেমিক স্ট্রোক : </strong>রক্তবাহী নালিকা ক্লট হয়ে বা জমে গিয়ে নালি সরু হয়ে যাওয়ার কারণে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। তখন এই স্ট্রোক হয়।</p> <p><strong>হেমোরেজিক স্ট্রোক :</strong> মস্তিষ্কের ভেতরে দুর্বল কোনো রক্তনালি ফেটে গেলে বা ছিদ্র হয়ে মস্তিষ্কের চারপাশে রক্তক্ষরণের কারণে এই ধরনের স্ট্রোক হয়। রক্ত মস্তিষ্কের ভেতর বা আশপাশে ছড়িয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া কোনো অংশ ফুলে যেতে পারে, মস্তিষ্কের কোষ বা টিস্যুগুলো ক্ষয়ে যেতে পারে।</p> <p><strong>ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিয়া অ্যাটাক :</strong> যখন মস্তিষ্কে রক্তসরবরাহ স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং ২৪ ঘণ্টারও কম সময় স্থায়ী হয়, তখন সেটা ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিয়া অ্যাটাক। এতে মস্তিষ্কে কোনো স্থায়ী ক্ষতি হয় না, কিন্তু পরে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।</p> <p> </p> <p><strong>উপসর্গ</strong></p> <p>►    হঠাৎ মুখ, হাত অথবা পায়ের এক পাশ দুর্বল হওয়া বা অবশ হয়ে যাওয়া।</p> <p>►    মাথা ঘুরানো, হাঁটতে ও ভারসাম্য রক্ষায় অসুবিধা।</p> <p>►    চোখে ঘোলা লাগা, অন্ধকার লাগা বা ডাবল দেখা।</p> <p>►    হঠাৎ খুব মাথাব্যথা।</p> <p>►    খিঁচুনি।</p> <p>►    কথা বলতে ও বুঝতে অসুবিধা হওয়া।</p> <p>►    মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা।</p> <p> </p> <p><strong>চেনার সহজ উপায়</strong></p> <p>সবার জন্য সহজে এবং দ্রুত স্ট্রোক শনাক্ত করার কার্যকর একটি পদ্ধতি বের করেছেন চিকিৎসকরা, যাকে বলে ফাস্ট। এর সাহায্যে যে কেউ স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিনে নিতে পারেন। স্ট্রোক হওয়ার সময় এই লক্ষণগুলো ভালোভাবে দেখতে হয়।</p> <p><strong>এফ = ফেস :</strong> অর্থাৎ লক্ষ করতে হবে রোগীর চোখ-মুখ ঝুলে গেছে কি না, হাত-পায়ে শক্তি রয়েছে কি না। অথবা মুখ বেঁকে গেছে কি না, হাসলে বেঁকে যাচ্ছে কি না?</p> <p><strong>এ = আর্মস :</strong> রোগী নিজে নিজে দুই হাত ওপরে তুলতে পারে কি না এবং একইভাবে কিছুক্ষণ ধরে রাখতে পারে কি না।</p> <p><strong>এস = স্পিচ : </strong>খেয়াল করতে হবে কথা বলতে গেলে জড়তা আসে কি না অথবা মুখের কথা এলোমেলো হয়ে যায় কি না।</p> <p><strong>টি = টাইম :</strong> যদি ওপরের তিনটি লক্ষণের যেকোনো একটি দেখা যায় তবে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিউরোলজির চিকিৎসা রয়েছে—এমন হাসপাতালে নিতে হয়।</p> <p>এসব লক্ষণ দেখেও রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে অনেক সময় সেই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।</p> <p> </p> <p><strong>চিকিৎসা</strong></p> <p>স্ট্রোকেরই কার্যকর চিকিৎসা রয়েছে। তবে কারো স্ট্রোকের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল লেবেল, ডায়াবেটিসের পরিমাণ, সিটি স্ক্যান, কারোটিড আলট্রাসনোগ্রাম, প্রয়োজনে এমআরআই, ইকো কার্ডিওগ্রাফি ইত্যাদি করে রোগীর সার্বিক অবস্থা দেখেন চিকিৎসকরা।</p> <p>ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগীকে রক্ত জমাটবাঁধা বা মস্তিষ্কে দ্রুত রক্তচলাচল চালুর জন্য জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসকরা দ্রুত সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। আবার হেমোরেজিক স্ট্রোকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়।</p> <p> </p> <p><strong>স্ট্রোক ও হৃদরোগ</strong></p> <p>স্ট্রোককে অনেকে হার্ট অ্যাটাক বলে ভুল করেন। স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সবার জানা দরকার, স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ এবং হার্ট অ্যাটাক হৃপিণ্ডের রোগ। স্ট্রোক শুধু ব্রেইনে হয়, এটা অনেকে জানে না। হার্ট অ্যাটাক হলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, আর স্ট্রোক হলে ম্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>যাঁদের ঝুঁকি বেশি</strong></p> <p>স্ট্রোক হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকে।  এর মধ্যে ঝুঁকি বেশি যাঁদের তাঁরা হলেন :</p> <p>►    সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সীরা।</p> <p>►    যাঁদের পরিবারে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক অথবা টিআইএ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।</p> <p>►    উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগী।</p> <p>►    যাঁদের স্থূলতা বেশি।</p> <p>►    যাঁদের কোলেস্টেরল বেশি।</p> <p>►    ধূমপায়ী।</p> <p>►    বায়ুুদূষণ।</p> <p>►    মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে।</p> <p>►    পলিসাইথেমিয়া ও থ্রম্বোসাইথেমিয়া রোগ হলে।</p> <p>►    অনিয়ন্ত্রিত হৃত্স্পন্দন থাকলে।</p> <p>►    অতিরিক্ত মদ্যপান।</p> <p> </p> <p><strong>প্রতিরোধে করণীয়</strong></p> <p>কিছু ভালো অভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, টেনশনমুক্ত জীবন, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, দেহের সঠিক ওজন বজায় রাখা, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, চর্বিজাতীয় খাবার বর্জন, অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধূমপান পরিহার স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য ভালো। এ ছাড়া শাকসবজি, দুধ, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, ভূষিসমৃদ্ধ খাবার, যেমন : ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত ইত্যাদি সুষম খাদ্য খাওয়া ভালো।</p> <p> </p> <p>গ্রন্থনা : <strong>আতাউর রহমান কাবুল</strong></p>