<p>পানছড়ি উপজেলার ১ নম্বর লোগাং ইউনিয়নের হাতিমারা স্নেহ মোহনপাড়ার দরিদ্র কৃষক শিবচরণ ও তবলা চাকমার মেয়ে শান্তনা চাকমা। ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করে পানছড়ি ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। কিন্তু অভাবের সংসারে সেই বছর আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৫ সালে পাড়ি জমান চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম ইপিজেডে খুঁজে নেন সাড়ে সাত হাজার টাকা বেতনে একটা চাকরি।</p> <p>সেখানে মাত্র চার মাস চাকরি করে নিজের খাওয়া খরচ পোশাকাদি কেনা এবং বাড়িতে মা-বাবাকে খরচ দিয়ে সঞ্চয় থাকে মাত্র এক হাজার টাকা। ওই টাকা নিয়েই ফিরে আসেন নিজ বাড়ি পানছড়িতে। গলার স্বর্ণের চেন বিক্রির সঙ্গে এক হাজার টাকা যোগ করে শুরু করেন জীবনযুদ্ধ।</p> <p>১১টি মুরগির ছানা, একটি শুকরের বাচ্চা আর একটি পুরাতন সেলাই মেশিন কিনে এসবের লালন-পালন পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন শান্তনা। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজে নিজে শিখে নেন সেলাইয়ের কাজ। গ্রামের মানুষের পোশাক সেলাই করে মাসে আয় হয় হাজার দুয়েক টাকা। এই ফাঁকে লেখাপড়া করে ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এক বিষয়ে অকৃতকার্য হন। এর পরও দমে যাননি। এক বিষয় পরীক্ষা হবে বছরখানেক পরে তাই সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করবেন। এরই মাঝে মুরগি ও শুকর বিক্রি করে পান ২০ হাজার টাকা। সেলাই ও বিভিন্নভাবে আয় করা ১০ হাজার, মুরগি ও শুকর বিক্রির ২০  হাজার সর্বমোট ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ২ বছরের চুক্তিতে নিজ এলাকায় নেন একটি দোকান বন্ধক। শুরু হয় মুদি দোকানের ব্যবসা।</p> <p>লোগাং বাজারের নবী সওদাগর থেকে বাকিতে মালামাল নিয়ে বিক্রির পর মহাজনের টাকা পরিশোধ করেন। এই ফাঁকে ২০১৭ এইচএসসি পাস করে পানছড়ি কলেজে ভর্তি হন স্নাতক (পাস) কোর্সে।</p> <p>লোগাং বাজারের ব্যবসায়ী নবী সওদাগর জানান, বছরখানেক ধরে শান্তনা চাকমা পাইকারি মালামাল নিচ্ছেন। সপ্তাহ-দশ দিন পর পর ১৫/২০ হাজার টাকার মালামাল  নিয়ে বিক্রি করে আমদানি দেন।</p> <p>শান্তনার এই সংগ্রামী জীবনের ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি খুবই গরিব পরিবারের সন্তান। আমরা এক ভাই এক বোন। ভাই বড় হলেও বেকার। তাই বুড়ো বাবার কষ্ট দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করা দরকার। শেষ পর্যন্ত অল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করি পাশাপাশি ডিগ্রি ২য় বর্ষে পড়ছি।’</p> <p>‘একা একা কষ্ট হয় তাই সহযোগিতার জন্য খাগড়াছড়ি কমলছড়ি বেতছড়ি এলাকার সোকত চাকমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি জানুয়ারিতে। বর্তমানে আমরা দুজনে মিলেই দোকান চালাই।’-যোগ করেন তিনি।</p> <p>শান্তনা জানান, পার্বত্য এলাকায় পরিস্থিতি খারাপের কারণে বেচাকেনা খুব কম। মহাজনের ৩০ হাজার টাকা দেনা এরই মাঝে মুদি মালের পাশাপাশি চা বিক্রিও চলছে। কোনো সংস্থা থেকে এ পর্যন্ত কিছু পাননি বলে তাঁর দুঃখ। বলেন, ‘সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা থেকে সাহায্য পেলে আরো অগ্রসর হতে পারব। এ ছাড়া সরকারি চাকরি করারও ইচ্ছাও আছে। কিন্তু চাকরিতো বর্তমান বাজারে সোনার হরিণ বলে ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দিছি।’</p> <p>হাতিমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজিত চাকমা ও সমাজসেবক রেবতী মোহন চাকমা বলেন, শান্তনা চাকমা এখন দুধুকছড়া এলাকার নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্বাবলম্বী হওয়ার মডেল। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেক নারী উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।</p> <p>লোগাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমা বলেন, ‘প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে শান্তনার এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তার নিজে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টাকে আমি শ্রদ্ধা করি। সে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলো তার সহায়তায় এগিয়ে আসা দরকার।’</p> <p>লোগাং ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতার চেষ্টা থাকবে বলেও জানান তিনি।</p> <p>পানছড়ি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মনিকা বড়ুয়া বলেন, ‘সম্প্রতি আমি এখানে যোগদান করেছি। যেসব নারী লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যবসা করে নিজের এবং পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের প্রতি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সব সময় আন্তরিক।’ খোঁজ-খবর নিয়ে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।</p> <p> </p>