<p>ঘরের বাজার করার জন্য ছয় টাকা দিয়েছিলেন মা। কিন্তু বাজার না করে সেই টাকায় মুক্তিযুদ্ধে চলে যান রাউজানের পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের কাঁঠালভাঙা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল বড়ুয়া। একাত্তরে ভারতের দেমাগ্রী, মিজোরাম ও হরিণাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এর পর রামগড় সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2016/print-2016/December/08-12-2016/kalerkantho-08-12-2016-20_1.jpg" style="float:left; height:63px; margin:12px; width:186px" />ভারতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদও ছিল বিমল বড়ুয়ার। এলাকাবাসী তাঁকে চিনেন-জানেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি। ওসমানীর সেই সনদ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক কাগজপত্র হারিয়ে যাওয়ায় তাঁকে নানাজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে।</p> <p>বিমল বড়ুয়ার আকুতি, ‘টাকা কিংবা সুযোগ-সুবিধার জন্য নয়, জীবনের শেষবেলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মরতে চাই।’</p> <p>পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের কাঠালভাঙা গ্রামের প্রয়াত অনুরোধ বড়ুয়া ও ননীবালা বড়ুয়ার পাঁচ সন্তানের সবার বড় বিমল বড়ুয়া। স্ত্রী পরপারে চলে গেছেন তিন বছর আগে। তাঁর চার মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। দুঃখ-কষ্টে কাটছে বিমলের জীবন।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বিমল বড়ুয়া বলেন, ‘একাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর মা আমাকে স্থানীয় হাট থেকে ঘরের বাজার আনার জন্য ছয় টাকা দিয়েছিলেন। বাজার না করে সেই টাকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে ঘর ছাড়ি। প্রথমে যাই রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালীতে। এর পর রাজারহাট হয়ে</p> <p>বাঙ্গালহালিয়ায় এক জেঠাতো ভাইয়ের বাড়িতে যাই। সেখানে দুদিন অবস্থানের পর জানতে পারি রাজারহাট এলাকায় বনবিভাগের অফিসের সামনে এলাকার কিছু লোক জড়ো করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য। গিয়ে দেখি, রাউজানের আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে যেতে সেখানে গেছেন।’</p> <p>সেখান থেকে বিমল বড়ুয়াসহ প্রায় দেড় শ জনের একটি দল রওনা দেয় ভারতের উদ্দেশ্যে। দুর্গম পথে পাঁচদিন হেঁটে দলটি পৌঁছে ভারতের আসাম জারিলতলা সীমান্তে। সেখান থেকে তাঁদের গ্রহণ করেন কয়েকজন অপরিচিত লোক। ভারতে ঢুকার পর তাঁদের বসানো হয় সেখানকার একটি আর্মি ক্যাম্পের সামনে। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক এসে সবাইকে তল্লাশি করেন। জানতে চান, কিছু প্রশ্নের উত্তর। এর পর তাঁদের রাত্রিযাপনের সুযোগ দেওয়া হয় সেখানে। পরদিন সবাইকে পাঠানো হয় ভারতের দেমাগ্রী আর্মি ক্যাম্পের অদূরে একটি শরণার্থী ক্যাম্পে। সেখানে নাম তালিকাভুক্ত করে ভর্তি করানো হয় মুক্তিবাহিনীতে। সেখানে প্রশিক্ষণ দেন দুজন ভারতীয় সৈনিক ও বাংলাদেশের দুই ইপিআর কর্মকর্তা আবদুর রহমান ও আবদুল জলিল।</p> <p>‘সেখানে অবস্থানের পর হঠাৎ করে বেশ কিছু ট্রাক ক্যাম্পে এসে আমাদেরকে উঠিয়ে নেয় অস্ত্রসহ। সাথে ছিলেন ভারতীয় সৈনিকদের সাথে আমাদের ইপিআর বাহিনীর কর্মকর্তা আবদুর রহমান ও আবদুল জলিল। আনা হলো ত্রিপুরায়। সেখানকার বগাপাহাড়ে এসে ফায়ারিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর পর আমাদের কয়েক ভাগ করে পাঠানো হয় ভারতের হরিণা ক্যাম্পে। যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তুত করে রামগড় দিয়ে পাঠানো হয় বাংলাদেশে।’-জানান বিমল বড়ুয়া।</p> <p>যুদ্ধে তাঁর কমান্ডার ছিলেন রাউজান মোহাম্মদপুরের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হাসেম। তাঁদের ৭৬ জনকে ভাগ করে ৩০ জনকে দেওয়া হয় রাইফেল, ২০ জনকে স্টেনগান, ২০ জনকে এসএল আর, চারজনকে এসএমজি ও দুজনকে এইচএমজি। অন্যদের নিয়ে আলাদা দল করা হয়। বিমলকে দেওয়া হয়েছিল এসএলআর। যার নম্বর ছিল ৪৫৭৮। যুদ্ধযাত্রায় প্রতিজনকে আরো দেওয়া হয়েছিল তিনটি আটার রুটি, ৩০ টাকা এবং একটি করে থালা ও মগ।</p> <p>বিমল বলেন, ‘রামগড়ে ঢুকে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করি রাউজানের দিকে। রাত হলে আশ্রয় নিতাম মগপাড়ায়। এভাবে দুদিন, দুরাত পর পৌঁছি রাউজানের পার্শ্ববর্তী পার্বত্য উপজেলা কাউখালীর কচুপাড়ায়। সেখানে আমরা ক্যাম্প করি। দুদিন অপেক্ষার পর ভারত থেকে আমাদের ক্যাম্পে আসেন কমান্ডার হাসেম ভাই। তাঁর পরিকল্পনায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিই।’</p> <p>প্রথমে তাঁরা টার্গেট করেন রাউজানে আমীরহাট এলাকায় অবস্থানকারী হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের। একদিন ভোরে হামলা করা হয় সেখানে। মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগ হয়ে হামলা করলে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। প্রায় আড়াই ঘণ্টার ওই যুদ্ধে দুই বীরযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন রাউজানের হিঙ্গলা গ্রামের পংকজ বড়ুয়া ও গহিরার নাজিম উদ্দিন। এর পর তাঁরা আরো কয়েকটি ছোটখাটো সফল অভিযান চালান।</p> <p>‘১৬ ডিসেম্বর জানতে পারি, শত্রুরা আত্মসমর্পণ করেছে। এর পর আমরা প্রকাশ্যে আসি। নিজেদের বাড়ি ঘরে গিয়ে পরিবারের সাথে মিলিত হই। একদিন সহযোদ্ধা স্বপন দাশ খবর দেন হালিশহরে কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদ বিতরণ করা হচ্ছে। আমিও অন্যদের মতো সেখান থেকে সনদ গ্রহণ করি। পরে কাছে থাকা অস্ত্র জমা দিতে গিয়েছিলাম রাউজানের পাবলিক হলে কমান্ডার হাসেম ভাইয়ের নির্দেশে। অস্ত্রসহ ট্রাকে আমাদের নেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ফৌজদারহাট আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে আমরা অস্ত্রগুলো জমা দিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধার সনদটি ঘরে রাখা হলেও পরবর্তীতে হারিয়ে যায়।’</p> <p>স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘বিমল বড়ুয়া সাহসী যোদ্ধা। তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’</p> <p>পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের মীরধারপাড়ার</p> <p>ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মা-বাবা, এলাকার গুরুজনদের কাছে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি বিমল বড়ুয়া একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর কাছে সরকারি কোনো স্বীকৃতি না থাকাটা বড় দুঃখজনক।’</p> <p>এ প্রসঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাশেম চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিমল বড়ুয়ার অবদান রয়েছে। তাঁর স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করতে হবে।’</p>