<p>রুটি।  খুব সাধারণ একটা খাবার, অন্তত আমাদের চোখে তাই। এর কোষ্ঠী-ঠিকুজি খুঁজতে গেলে রুটিকে কিন্তু আর সাধারণ বলে মনে হয় না।<br /> প্রথম এর যাত্রা শুরু ময়দা দিয়ে বানানো ‘চাপাটি’ দিয়ে। ঘটনাস্থল পারস্য এবং চাপাটি শব্দটা ফারসি । এর বাংলা মানে হচ্ছে চড় বা সোজা হিসেবে চটকানা বা থাপ্পড়। চাপাটি নামের পেছনের কাহিনি হচ্ছে, বানানোর প্রক্রিয়ায় ময়দার লেই হাতের তালুতে নিয়ে থাপড়ানো হচ্ছে দস্তুর। থাপড়ানো হচ্ছে একটা জিনিসকে, তা-ও আবার আদরের থাপ্পড়, সেই থেকে নামকরণের সুযোগ ধুরন্দর মানুষ ছাড়েনি, নাম দিয়ে দিয়েছে চাপাটি। নামও হলো আবার তার পেছনের চটকানাটাও থাকল। অনেকটা সেই কানকাটা রমজানের মতো। রমজান এমনিতেই নাটকের একটা খারাপ চরিত্র, কিন্তু তাতে বেশি খারাপ বোঝানোর জন্য কান কাটা শব্দটাও জুড়ে দেওয়া। ওরকম হয়ে গেছে বেচারা চাপাটির ক্ষেত্রেও।</p> <p>পারস্য থেকে এই চাপাটি ভারতের অওধে পৌঁছে হয়ে গেল রুটি আর উপকরণও গেল বদলে। ময়দার বদলে আটা। পারস্য থেকে অওধে পৌঁছানোর কারিগর অবশ্যই পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরা, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।</p> <p>ঝামেলা হচ্ছে এইটুকু- ইতিহাসও কিন্তু শেষ নয়। ইতিহাসের শেষ বলে সম্ভবত কিছু নেই। একসময় দেখা গেল, রুটির উৎস আসলে আফ্রিকা। সোহাহিলি উপজাতির কাছে রুটি নামক বস্তুটি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই খাবার হিসেবে চলে আসছে। আফ্রিকার এই ঘ্যাম যখন সবাই মেনে নিচ্ছে, ঠিক তখনই দেখা গেল সিন্ধু সভ্যতার আমলেও রুটি বেশ ভালোভাবেই ছিল। এতটাই ভালোভাবে যে সেই সভ্যতার মুদ্রায়ও রুটির ছবি খোদাই করা আছে। রুটিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ না হলে মুদ্রায় খোদাই করার কোনো কারণ দেখি না। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, বৈদিক যুগে হোম-যজ্ঞে ডাল বা সবজির পুর দেওয়া এক খাবার ব্যবহার করা হতো, নাম হচ্ছে ‘পুরোডাশ’-এর সঙ্গেও রুটি বা চাপাটির বেশ ভালো রকমের মিল পাওয়া যাচ্ছে।</p> <p>অদ্ভুত না? </p> <p>সোয়াহিলিতে যে বস্তু নিয়মিত খাওয়া হচ্ছে আবার সে জিনিস বৈদিক যুগের খানাপিনার মাঝেও আছে এবং আছে সিন্ধু সভ্যতার মুদ্রায়—সেই জিনিস এখন আমরা রাস্তার পাশে বসেই অমনোযোগের সাথে ছিঁড়েছুঁড়ে খেয়ে ফেলছি।</p> <p>এবারে আসি আজকের ঘটনা নিয়ে। বারো শতকে কর্ণাটকের রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর একটা গ্রন্থ গ্রন্থিত করলেন, তার একটা অংশে ছিল খাবার রেসিপি। সেই গ্রন্থের নাম ‘মনসোল্লাস’। এর বাংলা যদি বলা যায় তা হচ্ছে, ‘যা মনে উল্লাসের উদ্রেক করে’। খাবার যে মনে উল্লাসের উদ্রেক করে তাতে অন্য কারো সন্দেহ থাকলেও রাজা তৃতীয় সোমেশ্বরের সঙ্গে আমার মতের অমিল নেই। এই ভদ্রলোক ‘মনসোল্লাস’-এ আটার লেচির ভেতর বিভিন্ন রকমের পুর ভরে দিয়ে চমৎকার সব পদের কথা বলেছেন। যদিও ভদ্রলোক তাকে ‘পরোটা’ বলে সম্বোধন করেননি। তবে আটার লেইয়ের ভেতর বিভিন্ন পদের ইতিহাস পাওয়া গেল এখানেই।</p> <p>মুঘল জমানা যখন চালু হলো, পরোটা শব্দটা এসেছে তখন। মুঘলদের তো জীবনে তেমন একটা ঘি-মাখন জোটেনি, ভারতবর্ষে ঢুকে ঘি-মাখন দেখলেন। তারা আটার লেই বেলার সময় পরতে পরতে ঘি ঢুকিয়ে বিশেষ এক পদ বানালেন, নাম হলো ‘পরোটা’। পরতে পরতে আটা = পরোটা। এই পরোটা মুঘলরা খেতেন বিভিন্ন মাংসের পদের সাথে।</p> <p>তবে খাবার যেহেতু মানুষের পেটেই যায়, মানুষই নিজের জন্য বানিয়ে নেয়, তাই এই পরোটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। সবচেয়ে বেশি ছড়ালো উত্তর ভারতে। মাংসের জায়গায় পরোটার ভেতর কিমা ঢুকে গেল নিরামিষ। পর্তুগীজ রা এদিকটায় আলু আনার পর ঢুকলো আলু। পরোটার ভেতর আলু, হয়ে গেল আলু পরোটা। </p> <p>এই ফাঁকে একটা চমৎকার তথ্য দিয়ে রাখি। যাদের ধারণা ডালপুরি জিনিসটা খুব বেশিদিন আগে বানানো শুরু হয়নি, তাদের ধারণা ভুল। ডালপুরির সংস্কৃত নাম হচ্ছে ‘বেস্টনীকা’, মানে হচ্ছে এই বস্তু সেই বৈদিক যুগ থেকেই আছে। বাঙালি হিসেবে তাই পুরি নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করার কিছু নেই, এই খাবারও আমাদের নিজস্ব খাবার নয়।</p> <p>এত বিতং ভূমিকা বলার কারণ- আজ আলু পরোটা খেয়েছি। আটার লেইয়ের মাঝে পুরি স্টাইলে আলু ভর্তা (এর সঙ্গে আছে তাবৎ মসলা আর মরিচ) ভরে তাতে আচ্ছাসে পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা ঠেসে আবার লেইয়ের মতো করে রেখে দেওয়া কিছুক্ষণ। এরপর বেলে খাঁটি মাখনে ভাজা। খাঁটি মাখন গরম করলে এমনিতেই একটা আলাদা সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।</p> <p>তার ওপর এর সাথে যোগ হয়েছে আটা। আটার রুটির খোল কড়কড়ে করে ভাজা হচ্ছে, সেই সুগন্ধ চারপাশ ম ম করছে। মাখনের গলায় গান হলে আটার ভাজার সুগন্ধিটা হচ্ছে হারমোনিয়াম। দুই মিলে ‘আমি যামিনী, তুমি সখা হে…’</p> <p>প্লেটে এসে পড়ার পর পাশেই সালাদ, এক্সট্রা আলুভর্তা (বড় মানুষের ম্যাশড পটেটো মনে হয়)। সেই আলু পরোটার ওপরেও মাখন আছে ছোট্ট এক টুকরো। পরোটার উত্তাপে নিঃশব্দে গলে ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো পরোটার ওপর।</p> <p>ছিঁড়ে মুখে দিতেই সব মসলা একে একে হাজির জিহ্বার ঠিক নিচেই। শুধু মনটা এখন জিহ্বায় নিয়ে যাওয়া আর আস্তে আস্তে গোটা পরোটা খাওয়া। মাঝখানে কিছু নেই, কেউ নেই। আলুভর্তা আলাদা করে গরম মাখনের সুগন্ধের সঙ্গে মিশে কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আটার কড়কড়ে ভাজাটা দিচ্ছে ক্রিসপি একটা অনুভূতি। একই সঙ্গে ক্রিসপি এবং ক্যারামেলের মতো নরম বস্তু যে এভাবে চুলোতেও বানানো যায়, জানতাম না।</p> <p><strong>লেখক :</strong> অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী গবেষক ও চিকিৎসক<br />  </p>