<p>আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় সর্দি-কাশি, জ্বরসহ নানারকম রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এই সময়ে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত রোগের প্রকোপ কিছুটা বাড়ে। এই চিকেন পক্স নিয়ে নানা রকমের কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। কবিরাজী চিকিৎসা, ঝাঁঁড়-ফুঁক, পানি-পড়া ইত্যাদি নানা অপচিকিৎসা এবং রোগটি সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ধারণা কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবন সংকট হয়ে যায় রোগির। তাই কুসংস্কারে কান দেওয়ার আগে জেনে নিন চিকেন পক্স সম্পর্ক বিস্তারিত।</p> <p><strong>প্রশ্ন: বসন্ত রোগ কী?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>বসন্ত রোগ বলতে আমরা সেই রোগটিকেই বুঝি, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় চিকেন পক্স। একে অনেকে জলবসন্তও বলেন। আর এক ধরনের পক্স আগে হতো। সেটা হল স্মল পক্স বা গুটিবসন্ত। এটা এখন আর হয় না।</p> <p><strong>প্রশ্ন: বসন্তকালে কি এই রোগের প্রকোপ বাড়ে?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> শুধু বসন্তকালে নয়, বছরের যেকোনো সময়েই এই রোগ হতে পারে। তবে বছরের প্রথম ৬ মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেই এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।</p> <p><strong>প্রশ্ন: চিকেন পক্স কেন হয়?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই এটিও একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। ভ্যারিসেলা জস্টার (ভি-জেড ভাইরাস) নামে এক ধরনের ভাইরাসের জন্য এই রোগ হয়। অনুকূল আবহাওয়া পেলেই এই ভাইরাস সক্রিয় হয় ওঠে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে কী হয়?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> প্রাথমিক ভাবে জ্বর হবে। পরের ২-৩ দিনের মধ্যে জ্বরের মাত্রা বাড়বে। তার সঙ্গে সারা শরীরে ব্যথা হবে। ২-৩ দিন পর থেকে শরীরে র‌্যাশ বের হবে। র‌্যাশ যখন বের হয়, তখন চুলকানির অনুভব হবে। প্রথমে শরীরের মধ্য অংশের সামনের দিকে (বুক বা পেটে), পরে মুখমণ্ডলে র‌্যাশ বের হয়। পরে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। মুখগহ্বর এবং গলার মিউকাস আবরণীতেও র‌্যাশ বের হয়। ৫-৭ দিন পর্যন্ত র‌্যাশ বের হয়। সেটা ধীরে ধীরে জলভরা ফোস্কার মতো আকার নেয়। পরে ফোস্কার ভিতরের রস ঘন হয়ে পুঁজের মতো হয়। ৭-১০ দিন পর থেকে তা শুকোতে থাকে। শুকিয়ে যাওয়ার পরে র‌্যাশ থেকে খোসা উঠতে শুরু করে। চিকেন পক্সে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পরে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এই রোগটি কীভাবে ছড়ায়?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> এটি খুব ছোঁয়াচে রোগ। এই কারণে খুব সহজে এবং দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ মানুষের দেহে তা ছড়িয়ে পরে। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা থুতুর সঙ্গে ভাইরাস ছড়ায়। এমনকি, রোগীর সংস্পর্শে এলেও রোগ ছড়াতে পারে। তা ছাড়া, ফোস্কার মধ্যে যে রস থাকে তার মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। ওই রস সুস্থ ব্যক্তির শরীরে লাগলে রোগ হতে পারে। তবে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। শরীরে ঢোকার ১৪-২১ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে কত দিন অবধি রোগটি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>যত দিন র‌্যাশ বের হয় তত দিন তো বটেই, র‌্যাশ বের হওয়া বন্ধ হওয়ার পরেও দিন সাতেক পর্যন্ত এক জন আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রোগটির সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: কোন বয়সের মানুষের মধ্যে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>এটা নির্ভর করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরে। সব বয়সের মানুষের মধ্যেই এই ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তবে ১-১৪ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: কোন ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি মারাত্মক?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> গর্ভবতী নারী, বয়স্ক মানুষ এবং সদ্যজাত শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগটি মারাত্মক। এ ছাড়া যারা 'ইমিউনো কম্প্রোমাইজড' এবং যারা 'স্টেরয়েড থেরাপি' তে আছেন তাদের জন্য বিপজ্জনক। অর্থাৎ যারা এমন কিছু ওষুধ খান, যে ওষুধ খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগটি মারাত্মক হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের চিকেন পক্স হলে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি থাকে। আর যদি প্রসবের দিন সাতেকের মধ্যে মায়ের এই এই রোগ হয়, তখন নবজাতকের মারাত্মক ধরণের জলবসন্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তখন ওই শিশুর বিশেষ চিকিৎসা ও যত্ন দরকার।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এই রোগ থেকে কোনো জটিলতা তৈরি হতে পারে কি?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকলে বা কম থাকলে নানা জটিলতা হতে পারে। সাধারণ ভাবে যে সমস্যাগুলি হয় সেগুলি হল, র‌্যাশ বের হওয়ার সময় চুলকানি এলে অনেকে চুলকিয়ে ফেলেন। তখন তা থেকে ক্ষত এবং সংক্রমণ হতে পারে। নিউমোনিয়া বা মস্তিষ্কে প্রদাহও হতে পারে। এ ছাড়া স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি বা লিভারের সমস্যাও হতে পারে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: চিকেন পক্স হলে কীভাবে বোঝা যাবে?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> ক্লিনিক্যালি দুই-একটি র‌্যাশ না বের হওয়া পর্যন্ত সাধারণভাবে দেখে বোঝা যায় না। ওই র‌্যাশের রস সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সব সময় তা করার দরকার হয় না। প্রাথমিকভাবে র‌্যাশের প্রকৃতি ও ধরন দেখেই রোগ নির্ণয় করা হয়।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এর চিকিৎসা কী ভাবে করা হয়?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>এটি কোনো জটিল রোগ নয়। তবে অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ আছে। র‌্যাশ বের হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা প্রয়োগ করতে পারলে শরীরে অনেক কম র‌্যাশ বের হয় বা জ্বালা, যন্ত্রণা থেকে উপশম পাওয়া যায়। ঝুঁকিও কম থাকে। কিন্তু গর্ভবতী মা, সদ্যজাত বা ইমিউনো কম্প্রোমাইজড ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হয়। তা না হলে, সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এছাড়া, উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করা হয়। যেমন, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা বেশি চুলকানি হলে তা কমানোর জন্যেও ওষুধ দেওয়া হয়। এর সঙ্গে শরীরের দুর্বলতা কাটাতে ভিটামিন ওষুধ দেওয়া হয়। প্রোটিন যুক্ত খাবার খেতে বলা হয়। প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে বলা হয়।</p> <p><strong>প্রশ্ন: রোগীর পরিচর্যা কেমন ভাবে করা উচিত?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> রোগীকে ঠান্ডা লাগতে দেওয়া যাবে না। সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে। বিশেষ করে উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাবার বেশি করে খেতে দিতে হবে। যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য কারও মধ্যে রোগটি না ছড়িয়ে পরে, সেভাবে ঘরের মধ্যে রাখতে হবে। র‌্যাশের খোসা না-ওঠা পর্যন্ত ঘরের মধ্যেই থাকতে হবে। বেশি করে জল পান করতে হবে। নিয়মিত অল্প গরম জলে হালকা ভাবে শরীর মোছাতে হবে, যাতে ফোস্কা না গলে যায়। তবে শরীরে তেল দেওয়া যাবে না।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এর রোগটি প্রতিরোধের উপায় কী?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে দূরে থাকাই একমাত্র উপায়। তাই কেউ আক্রান্ত হলে তাকে বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায় একটি এলাকাই এই রোগটি বেশি ছড়াচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এই রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে?</strong></p> <p>উত্তর: হ্যাঁ আছে। যাঁরা চিকেন পক্সে আক্রান্ত হননি, তাদের টিকা দেওয়া যেতে পারে। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের এই টিকা দেওয়া হয়। তবে, বেশি বয়সের ব্যক্তিরাও এই টিকা নিতে পারেন।</p> <p><strong>প্রশ্ন: এই রোগে আক্রান্ত হলে দেখা যায় খাবারের ব্যাপারে নানা বিধিনিষেধ মানার প্রথা রয়েছে। এটি কতটা বিজ্ঞানসম্মত?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> এটি বিজ্ঞানসম্মত তো নয়ই, বরং অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর আর বিপজ্জনক। পরিস্কার কর বললে এটা এক ধরনের কুসংস্কার। এই সময় রোগীর শরীরে দুর্বলতা তৈরি হয়। তাই রোগীকে উচ্চ প্রাণীজ প্রোটিন সম্বৃদ্ধ খাবার দেওয়া উচিত। বিশেষ করে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রাণীজ প্রোটিন জাতীয় খাবার দিতে হয়। তবে অবশ্যই তা সহজপাচ্য হতে হবে।</p> <p><strong>প্রশ্ন: কারও এক বার চিকেন পক্স হয়ে গেলে তার কি ফের ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে?</strong></p> <p><strong>উত্তর:</strong> না। কারণ, যার এক বার চিকেন পক্স হয়েছে, তার শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। তাই পুনরায় ওই রোগে হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।</p> <p><strong>প্রশ্ন: টানা বৃষ্টি এই রোগে কোনো প্রভাব পড়তে পারে কী?</strong></p> <p><strong>উত্তর: </strong>না। এটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। তাই এই বৃষ্টিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।</p> <p><span style="font-size:8px">-আনন্দবাজার অবলম্বনে</span></p>