<p>আমেরিকান সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথা ও ঐতিহ্য। লন্ডনের বার্নেট এবং সাউথগেট কলেজের নৃবিজ্ঞানী ক্রিস্টিনা ডে রোসি বলেন, “সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছেদ, পোশাক পরার পদ্ধতি, ভাষা, বিবাহ, সঙ্গীত, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত নীতি বোধ, অর্থাৎ আমরা কোনটাকে ঠিক আর কোনটাকে বেঠিক বলে বিশ্বাস করি, আমরা কীভাবে টেবিলে বসি, কীভাবে আমরা অতিথিকে অভিবাদন জানাই, কীভাবে ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে আমরা আচরণ করি এবং আরো কয়েক লাখ বিষয়”।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। যার জনসংখ্যা প্রায় ৩২ কোটি ৫০ লাখ। সেখানে প্রতি ৮ সেকেন্ডে একটি নতুন শিশু জন্ম গ্রহণ করে। আর প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন মানুষের মৃত্যু হয়।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার বেশিরভাগই অভিবাসী। এমনকি এখনো প্রতি ৩৩ সেকেন্ডে একজন করে নতুন অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে।</p> <p>আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্রময় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ইংরেজরা। যারা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই সেখানে উপনিবেশ গড়ে তুলতে থাকে। এছাড়া স্থানীয় আদিবাসি (রেড ইন্ডিয়ান), ল্যাটিন আমেরিকান, আফ্রিকান এবং এশিয়ানরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে।<br /> সারা বিশ্বের নানা অঞ্চলের সংস্কৃতি যেভাবে মার্কিন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে সেভাবেই আবার আজ আমেরিকান সংস্কৃতি প্রভাবিত করছে পুরো বিশ্বকে।</p> <p>‘পশ্চিমা সংস্কৃতি’ পরিভাষাটি দিয়ে প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ যেভাবে মিশেছে তা একটু ভিন্নই বটে। উদারহণত, যুক্তরাষ্ট্রে এসে স্প্যানিশ-ভাষী ক্যাথলিক সম্প্রদায় হয়তো তাদের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক পারিবারিক ঐতিহ্যগুলো অনুসরণ করছে ঠিকই কিন্তু শহুরে জনগোষ্ঠীতে একীভুত হয়ে গেছে এবং নানভাবে আমেরিকান জীবনা যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্ব, দক্ষিণ, মধ্যপশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলগুলোর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য এবং রীতি।</p> <p>ভাষা<br /> যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষিত কোনো দাপ্তরিক ভাষা বা রাষ্ট্র ভাষা নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটিতে প্রায় পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষেরই বাস রয়েছে। এবং সবাই তাদের নিজের ভাষাতেই কথা বলে। ইংরেজি ছাড়াও আর যেসব ভাষা খুব বেশি বলা হয় সেগুলো হলো- স্প্যানিশ, চীনা, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ৯০% মানুষ অন্তত কিছুটা হলেও ইংরেজি বোঝেন এবং বেশিরভাগ বেশিরভাগ দাপ্তরিক কাজই ইংরেজিতে সম্পন্ন হয়। উদাহরণত, হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ইংরেজি এবং হাওয়াইয়ান ভাষা হলো দাপ্তরিক ভাষা।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর হিসেব মতে, মার্কিন নাগরিকরা প্রায় ৩০০-রও বেশি ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষাগুলোকে চার ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে- স্প্যানিশ, ইংরেজি ভিন্ন অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা যার মধ্যে রয়েছে জার্মান, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বা ঐ অঞ্চল থেকে আগত ইহুদিদের ভাষা, সুইডিশ, ফরাসি, ইটালিয়ান, রাশিয়ান, পোলিশ, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গ্রিক এবং আরো কয়েকটি, এশিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহের ভাষা যার মধ্যে রয়েছে- চীনা, কোরিয়ান, জাপানীজ, থাই, তামিল এবং অন্যান্য এমন সব ভাষা যেগুলো উপরোক্ত তিন ক্যাটেগরির কোনোটিতে পড়েনা; যেমন, হাঙ্গেরিয়ান, আরবী, হিব্রু, আফ্রিকার ভাষাসমূহ এবং উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসিদের ভাষাসমূহ।</p> <p>ধর্ম<br /> পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চর্চিত হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭১% মানুষ নিজেদেরকে খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেয়। ২০১৭ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক নিরপেক্ষ জরিপে সংগৃহীত তথ্য থেকে এমনটাই প্রমাণিত হয়েছে। ওই গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২৩% মানুষের ধর্মের সঙ্গে কোনো যোগ নেই। আর দেশটির জনসংখ্যার ৬% মানুষ খ্রিস্টান ধর্মভিন্ন অন্য ধর্মের মানুষ। এছাড়া যারা নিজেদেরকে কোনো ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে পরিচয় দেন না তাদের সংখ্যা কমছে বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ছিল ১৬% যা ২০৬০ সালে কমে ১৩ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।</p> <p>আমেরিকান স্টাইল<br /> সামাজিক মর্যাদা, অঞ্চল, পেশা এবং জলবায়ু ভেদে পোশার পরার স্টাইলও ভিন্ন। জিনস, স্নিকার, বেসবল ক্যাপ, কাউবয় হ্যাট এবং বুট এসবই হলো মার্কিন পোশাক। র্যালফ লরেন, ক্যালভিন ক্লেইন, মিশেল কোরস এবং ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট হলো আমেরিকার জনপ্রিয় ব্র্যান্ড।</p> <p>আমেরিকান ফ্যাশন তারকাদের এবং গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত। প্রতি বছর ফ্যাশন বিক্রির পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাপত্রে এমনটাই বলা হয়েছে। আর অনলাইনেই বেচা বিক্রি বাড়ছে বেশিহারে। ২০১৭ সালের প্রথমার্ধে ই-কমার্স সেল এর পরিমাণ ছিল ৯৮.১ বিলিয়ন।</p> <p>আমেরিকান খাদ্য<br /> প্রথম দিকে আমেরিকান খাদ্যাভ্যাস ইউরোপীয় এবং আদিবাসিদের দ্বার প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মূলত হামবার্গার, হট ডগ, পপেটো চিপস, ম্যাকারোনি, পনির এবং মাংসরুটি এগুলোকেই বলা হয় মার্কিন খাদ্য।<br /> তবে বিশেষ অঞ্চলভেদে রান্না ও খাদ্যের ধরণেও পার্থক্য রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রান্নার ধরনকে প্রায়ই বলা হয়, ‘আমেরিকান কমফোর্ট ফুড’। এর মধ্যে রয়েছে, ফ্রাইড চিকেন, সবুজ শাক, কালো মটরশুটি এবং ভুট্টা রুটি। টেক্সমেক্স জনপ্রিয় টেক্সাস এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এটি স্প্যানিশ এবং মেক্সিকান রান্না পদ্ধতির মিশ্রণ। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচা মরিচ, বারিটো এবং চিটে পনির ও মটরশুটির ওপর বেশি নির্ভরশীল। স্ন্যাকস নামের খাদ্যটির জন্মই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।</p> <p>শিল্প<br /> যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম এবং টেলিভিশন ও সিনেমা উৎপাদনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে বলেই সবাই জানেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের হিসেব মতে, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ও বিনোদন শিল্পের মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশই হয় যুক্তরাষ্ট্রে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন শিল্পের বিকাশ ঘটে ১৯৫০ এর দশকে। আর দুনিয়াব্যাপীই এখন মার্কিন টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখানো হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালি সিনেমা শিল্প। বিশ্বব্যাপীই মার্কিন সিনেমা বেশ জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে মার্কিন সিনেমা শিল্প আয় করেছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। এই আয় ২০১৯ সালে ৭৭১ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।</p> <p>টেলিভিশন এবং সিনেমা ছাড়া মঞ্চ অভিনয়ও যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয়। মার্কিন লোক শিল্পও বেশ সমৃদ্ধ। আর মার্কিন সঙ্গীত অনেক অনেক স্টাইলে বৈচিত্রময়। যার মধ্যে রয়েছে, ব্লুজ, জ্যাজ, গসপেল, কাউন্ট্রি এবং পশ্চিমা, ব্লুগ্রাস, রক ‘এন’ রোল এবং হিপ হপ।</p> <p>খেলাধুলা<br /> যুক্তরাষ্ট্র মূলত একটি খেলাধুলামনা দেশ। ফুটবল, বেসবল, বাস্কেট বল এবং হকি খেলা বেশ জনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো খেলা বেসবল। ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা এই খেলা সুসংগঠিত হয় এবং জনপ্রিয়তা পায় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তবে গত তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তাও বেড়ে চলেছে।</p> <p>আমেরিকান হলিডে<br /> ৪ জুলাই মার্কিনিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা দিবস পালন করে। মে মাসের শেষ সোমবার পালন করা হয় স্মৃতি দিবস। এই দিনে সামরিক সেবা দিতে গিয়ে নিহতদের স্মরণ করা হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার পালন করা হয় শ্রমিক দিবস। থ্যাঙ্কসগিভিং ডে পালন করা হয় নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার। ফসল সংগ্রহ উদযাপনে এই দিবস পালন করা হয় সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই। প্রেসিডেন্ট ডে পালন করা হয় ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সোমবার। দিনটি পালন করা হয় জর্জ ওয়াশিংটন এবং আব্রাহা লিঙ্কনের জন্মদিন পালনে। ১১ নভেম্বর পালিত হয় সেনা দিবস। জানুয়ারির তৃতীয় সোমবার বেসামরিক অধিকার আন্দোলন নেতাদের অবদান স্মরণে বেসামরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে স্মরণ করা হয়।</p> <p>সূত্র: লাইভ সায়েন্স</p>