<p>প্রশ্ন: আমাদের ৭ ও ৪ বছর এবং চার মাসের তিনটি সন্তান আছে। আমাদের সবচেয়ে বড় সন্তানটিকে সহানুভূতি এবং অন্যের প্রতি যত্ন বিষয়ক ধারণাগুলো শিক্ষা দিতে গিয়ে আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি। সে প্রায়ই চরম স্বার্থপর আচরণ করে। তবে সে স্বভাবগতভাবেই স্বার্থপর নয় বরং অন্যমনস্কতার কারণে এমনটা ঘটে।<br /> কিন্তু এতে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা তার কোনো পরোয়াই সে করে না। তার এমন আচরণ দেখে আমরা তার সঙ্গে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান ও যত্নবান হওয়ার বিষয়ে কথা বলি। এছাড়া সম্পত্তির প্রতি সম্মান এবং নিজের তৎপরতা কীভাবে অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলছে সেসব নিয়েও কথা বলি।<br /> এছাড়া আমরা তার মধ্যে ধীরে ধীরে কৃতজ্ঞতাবোধ সম্পর্কিত চিন্তা প্রবেশ করাই। এজন্য আমরা প্রতিদিন রাতের খাবারের পর পরস্পরকে নিয়মিতভাবে ধন্যবাদ দিই এবং পরস্পরের প্রশংসা করি। কিছু জিনিস আছে যেগুলো সহজেই গেঁথে যায়, কিন্তু অন্যগুলো গাঁথে না। ফলে আমরা ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছি। এক একটি নতুন শিশু জন্ম নেওয়ার পর আমাদের পরিবারে অনেক উত্থান-পতন ঘটে। সুতরাং আমরা এখন ধৈর্য্য ধরে তার মানসিক উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায় এবং পরিপক্কতার মাত্রা বুঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিষয়টি খুবই কঠিন। পরামর্শ চাই।<br /> উত্তর: রাতের সংবাদে দুনিয়াব্যাপী নৃশংসতার নানা চিত্র দেখে আমি হয়তো তর্ক তুলতে পারি শুধু বাচ্চারাই নয় বরং প্রাপ্তবয়স্করাও এখন সহানুভূতি এবং স্বার্থপরতা ইস্যুতে খুব কঠিন সময় পার করছেন। আর বাচ্চাদের স্বার্থপরতার পেছনে অন্তত একটি ভালো যৌক্তিক কারণ আছে: অপরিপক্কতা।<br /> সুতরাং, আপনার ৭ বছর বয়সী সন্তানের বেলায় সমস্যাটা কী?  আসলে আমরা প্রাপ্তবয়স্করাও প্রায়ই ক্ষুধা, ক্লান্তি এবং এমনকি স্বাভাবিক অবস্থায়ও অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কথা ভুলে যাই। আর মাত্র ৭ বছরের একটি বাচ্চার জন্য এমন জটিল বিষয় অনুধাবন করা আরো কঠিন।<br /> অন্যের অনুভূতি বুঝার আগে একটি ৭ বছরের বাচ্চার তার নিজের অনুভূতিগুলো সম্পর্কে বুঝ দরকার। তার অনুভূতিগুলো নিজের পছন্দে অগ্রাধিকারের বিষয়ে খুবই স্পষ্ট। যেমন সে হয়তো স্ট্রবেরির চেয়ে আইসক্রিম বেশি পছন্দ করে। এছাড়া নিজের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টতার বিষয়টিও স্পষ্ট। কিন্তু নতুন কোনো সহদোরকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে তার অনুভূতি আরো বেশ জটিল রুপ ধারণ করে।<br /> আপনাদের পরিবারে প্রতি তিন বছর পরপর একটি নতুন সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। আর আপনার জেষ্ঠ সন্তানকে এজন্য পরিবারে তার নিজের বরাদ্দ জায়গার কিছুটা নতুন সন্তানের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছে। আর নতুন পরিবেশের সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। এসময় তার মধ্যে দুটি বিপরীতমুখী অনুভূতি কাজ করে: নতুন সহোদরের জন্য তীব্র স্নেহ এবং একইসঙ্গে হিংসার অনুভূতি। কারণ পরিবারে তার স্থানটুকু আগের চেয়ে সংকুচিত হয়ে এসেছে।<br /> যেসব পরিবারে একাধিক সন্তান আছে তার প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এমনটি ঘটে থাকে।<br /> আপনারা বলেছেন, আপনাদের সন্তান স্বভাবগতভাবেই নিষ্ঠুর নয়। বরং অন্যমনস্কতার কারণেই সে মাঝেমধ্যে নিষ্ঠুর আচরণ করে। তার মধ্যে অপরের প্রতি দয়া ও সহানুভূতিশীলতা প্রবেশ করানোর যে চেষ্টা আপনারা করছেন সেটা খুবই ভালো একটি প্রচেষ্টা। তবে আসুন তার ভেতরের কিছু অনুভূতিও আমরা বুঝার চেষ্টা করি।<br /> এমনও হতে পারে আপনার বড় সন্তানটি তার ছোট সহদোরকে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। কারণ চার বছরের ছোট বাচ্চার কান্নাকাটি এবং চাহিদাগুলো সামাল দিতে গিয়েই হয়তো আপনাদের বাবা মা দুজনকেই হিমশিম খেতে হয়। এতে আপনাদের ৭ বছরের বাচ্চাটি হয়তো নিজের কথাগুলো বলার সুযোগ পাচ্ছে না। আপনারা হয়তো ছোট সন্তানটির প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে তাকে অগ্রাহ্য করছেন। আর একারণেই হয়তো রাগে ও ক্ষোভে সে মাঝে মধ্যেই স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে। তার এই স্বার্থপরতা আসলে তার বঞ্চনাবোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।<br /> সুতরাং তার মধ্যে জোর করে সংবেদনশীলতা ও দয়ার অনুভূতি প্রবেশ করানোর চেষ্টা করবেন না। এতে তার মধ্যে নিজের প্রতি ঘৃণার অনুভূতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর বদলে বরং ছোট সন্তানটিকে আপনারা যেভাবে ভালোবাসা ও আদর সোহাগ দিচ্ছেন বড় সন্তানটিকেও তা সমানভাবে দিন।<br /> সুতরাং সময় সুযোগ হলেই ছোট সন্তানটির পাশাপাশি বড় সন্তানটির প্রতিও মনোযোগী হন। এতে তার মধ্যে আর এই অনুভূতি হবে না যে আপনারা তাকে অগ্রাহ্য করছেন। ফলত তার মনটিও আপনাদের এবং ছোট্ট সহদোরটির প্রতি নরম হয়ে আসবে। আর এভাবেই একমাত্র বাচ্চাদেরকে সহানুভূতি এবং অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শণের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। লেকচার বা জোরপূর্বক প্রশিক্ষণ নয় বরং নিজেই অপরের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শণের মডেল হয়ে উঠতে হবে। আর শুধু এভাবেই, নিজেই মডেল হয়ে ওঠার মাধ্যমেই বাচ্চাদেরকে সহানুভূতি এবং অপরের প্রতি দয়ার বিষয়টি শেখানো সম্ভব।<br /> যখনই আপনার বাচ্চাটি কোনো বিষয়ে অভিযোগ করবে তখনই তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করুন। এতে নিজেকে সে আরো নিরাপদ এবং ভালোবাসাপ্রাপ্ত হিসেবে ভাবতে শিখবে। প্রতিদিনই আপনি প্রায়শ এবং মাঝেমধ্যে ও স্বাধীনভাবে এটা করতে পারেন। এই ধরনের সংযোগ গড়ে তোলার চেয়ে অলৌকিক ফলদায়ক কিছু আর হতে পারে না। সুতরাং বিষয়টির চর্চার জন্য একটি গোছানো পরিকল্পনা তৈরি করুন।<br /> আর রাতের খাবারের সময় পরস্পরকে ধন্যবাদ জানানোর মাধ্যমে বাচ্চাকে সহানুভূতি ও কৃতজ্ঞতাবোধের যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তা আরো আনন্দদায়ক পদ্ধতিতে করুন। কারণ দিনশেষে কেউই লেকচার শুনতে পছন্দ করে না। বিশেষত বাচ্চারা তা বেশি অপছন্দ করে। সুতরাং হাসি, ঠাট্টা এবং আরো আনন্দদায়কভাবে সেটি করুন। অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও তা করুন। এতে আপনার বাচ্চাটি স্বস্তিতে ঘুমাতেও যেতে পারবে। এবং আরো বেশি শিথিল এবং নিরুদ্বেগভাবে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারবে।</p>