<p>রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ব্যাপক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি। মূলত পূর্বাচল প্রকল্প ঘিরে রূপগঞ্জ ও গাজীপুর অংশের ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে করা হচ্ছে নানা অনিয়ম। কেউ কেউ নিজেদের ‘আদি বাসিন্দা’ ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ গ্রহীতা দাবি করে ভুয়া বরাদ্দপত্র দিয়ে লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার প্রকৃত বরাদ্দ পাওয়া ‘আদি বাসিন্দা’ লোকজনও নিজেদের একটি প্লট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করছে। বরাদ্দ পাওয়া প্লট প্রতারণার মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবাসিক প্লটের কাগজপত্র পরিবর্তন করে তা বাণিজ্যিক বলেও বিক্রি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে  রাজউকের পূর্বাচল সেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্মচারী ইউনিয়ন ও বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতাদের জড়িত থাকারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের প্রতারণার খপ্পরে পড়ে প্লট কেনার পর দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশের খবর পাচ্ছেন ক্রেতারা। ইতিমধ্যে এমন বিপুল অভিযোগ জমা পড়েছে রাজউক চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পূর্বাচল সেলের কর্মকর্তাদের কাছে। রাজউক বেশ কিছু ভুয়া বরাদ্দ বাতিল এবং এক বরাদ্দের বিপরীতে একাধিক ক্রেতাকে ঠকানোর ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছে।</p> <p>পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে একটি স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হয়েছে। এই স্বীকৃতিপত্র সংশ্লিষ্টদের কাছে ‘অ্যাওয়ার্ড’ নামে পরিচিত। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ‘আদি বাসিন্দা’ ক্যাটাগরিতে প্লট দেওয়া হচ্ছে।</p> <p>অনিয়ম-প্রতারণার বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তরা নিয়ম মাফিক প্লট পেয়েছে। এখন তারা যদি এক প্লট একাধিক জায়গায় বিক্রি করে তাহলে আমাদের পক্ষে সেটা প্রতিরোধ করা কঠিন। তবু আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। ক্রেতাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, পূর্বাচল থেকে প্লট কেনার আগে যাচাই-বাছাই করে নিন।’</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মান্নান ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে রাজউক থেকে একটি প্লট বরাদ্দ পান। পাঁচ কাঠার প্লটটি তিনি মো. তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে ৯০ লাখ টাকা দাম নির্ধারণ করে ১২ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে একটি বায়না দলিল করে দেন। তোফাজ্জল হোসেন সেই জমির কাগজপত্র নিয়ে রাজউকে এসে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরু করে দেখতে পান হাবিবুর রহমান ও আশরাফুল ইসলাম বাচ্চু নামের দুই ব্যক্তির কাছে আরো আগেই প্লটটি বিক্রি করা হয়েছে। পরে তোফাজ্জলসহ ওই দুই ক্রেতা এ বিষয়ে রাজউকের দ্বারস্থ হন। কিন্তু রাজউক থেকে চিঠি দিয়ে ডাকা হলেও মান্নান হাজির হননি।</p> <p>তোফাজ্জল হোসেন জানান, তিনি তাঁর আত্মীয় সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাফায়েতুর ইসলামের জন্য প্লটটি কিনেছেন। এখন মান্নানের প্রতারণার জন্য তিনি আত্মীয়কে প্লটটি দিতে পারছেন না। মান্নান টাকাও ফিরিয়ে দিচ্ছেন না।’</p> <p>করিমা খাতুন ও আকবর হোসেন ২০১১ সালে ২৪ জানুয়ারি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে পূর্বাচলে তিন কাঠার একটি প্লট পান (প্লট নম্বর-০৯-৩১৯-০১৩)। সেটি তাঁরা ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর খোরশেদ আলম (তারা) নামের একজনকে রেজিস্ট্রি বায়না করে দেন। আবার একই প্লটের বিপরীতে তাঁরা ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট আবু হাসান মো. ইনা ইলাহী, উম্মে কুলসুম ও শরাবন তহুরা নামের তিনজনকে আমমোক্তার দেন। পরে উভয় মালিকপক্ষ রাজউকে হাজির হয়ে বিষয়টি জানায়। রাজউকের পূর্বাচল সেল থেকে বিষয়টি জানানো হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।</p> <p>রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই রাজউকের বোর্ড সভায় প্লটটির বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। ওই সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বলা হয়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে মূল আদি বাসিন্দা ক্যাটাগরিতে তিন কাঠার প্লট পাওয়া করিমা খাতুন ও আকবর হোসেন একাধিক ব্যক্তিকে প্রতারণার মাধ্যমে আমমোক্তার নিয়োগ করেছেন। তাই তাঁদের (করিমা ও আকবর) নামে বরাদ্দ করা প্লটটি বাতিল করা হলো। একই সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে আমমোক্তার নিয়োগ করায় এ দুজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়।</p> <p>রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অ্যাওয়ার্ড জালিয়াতি করেছে জেলা প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা-কর্মচারী। অনেক সময় ভুয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়ে তাঁরা রাজউক থেকেও প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। আবার একটি অ্যাওয়ার্ড দিয়ে একাধিক প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগও অনেক। জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া এসব প্লট তাঁরা বিক্রি করছেন সাধারণ মানুষের কাছে। ক্রেতারা প্লট কিনে রাজউকে গিয়ে বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরুর পর জালিয়াতির তথ্য ধরা পড়ে।</p> <p>রাজউকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পূর্বাচলে আদি বাসিন্দা ক্যাটাগরিতে আছিম উদ্দিন (পিতা শমসের আলী) ও ছালেহা খাতুনের (স্বামী বছির উদ্দিন) নামে যৌথভাবে তিন কাঠার একটি প্লট (কোড নম্বর-৫২৭৯৫) বরাদ্দ দেওয়া হয়। ছালেহার স্বামী বছির উদ্দিন বরাবর তিন কাঠার আরেকটি প্লট (কোড নম্বর-৫১৮২৭) বরাদ্দ দেওয়া হয়।  আবার অলি উল্লাহ প্রধান ও ছালেহা খাতুনের নামে যৌথভাবে তিন কাঠার একটি প্লট (কোড নম্বর-৫২৬৬৩) বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে এ তিনজনের দাখিল করা ঘরের অ্যাওয়ার্ড ক্রমিক নম্বর একই, ১৭৬। মূলত একটি ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাওয়ার্ড দিয়ে প্রতারণার ম্যাধমে তিনটি প্লট বাগিয়ে নিয়েছে এ চক্র।</p> <p>টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল আলম জানান, তিনি পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে তিন কাঠার একটি প্লট কিনেছেন। প্লটের রেজিস্ট্রেশনের পর নামজারি করতে গিয়ে দেখেন একই প্লটের আরো দুইজন দাবিদার রয়েছেন। তাঁরাও রাজউকে এসে নিজেদের ক্রয়সূত্রে মালিক দাবি করছেন। এ নিয়েও বিপাকে রয়েছে রাজউক।</p> <p>নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাজউকের কর্মচারী ইউনিয়ন ও বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় বহিরাগতদের একটি চক্র পূর্বাচল সেলে সক্রিয় রয়েছে। তারা কখনো আবাসিক প্লটকে পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক বলে বিক্রি করে; আবার পূর্বাচলে বরাদ্দকৃত প্লটের মালিকের কাছ থেকে বায়না করে তা একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে সাহস পান না। বললে দলবল নিয়ে এসে রুমে হুমকি-ধমকি দেয়। মূলত এ জন্য সেল থেকে দালালদের সরানো যাচ্ছে না। তবে নতুন চেয়ারম্যান আসার পর পূর্বাচল সেল সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার কাজ শুরু করেছেন।</p> <p>রাজউকের (পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প) পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পূর্বাচলে বেশির ভাগ আদি বাসিন্দা এক প্লট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছে। কয়েকটি বিষয় আমরা বোর্ড সভায় বাতিলও করেছি।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে সংস্থার চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন এই কর্মকর্তা।</p> <p>রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, পূর্বাচল নতুন শহরের আদি বাসিন্দা ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের প্লট নিয়ে মূলত জালিয়াতি হয়। এসব অ্যাওয়ার্ডের বিপরীতে পাওয়া প্লট তারা একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রি করছে। এর সঙ্গে স্থানীয় লোকদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা রাজউকে ঘুরে ঘুরে ক্রেতাদের কাছে নিজেদের বরাদ্দমূলে প্লটের মালিক হিসেবে পরিচয় দেয়। সেখান থেকে ক্রেতা ধরে তারা আদি বাসিন্দা ক্যাটাগরির প্লট বিক্রি করে।</p> <p>অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায় গত ৯ অক্টোবর। সেদিন দুপুর দেড়টার দিকে রাজউকের পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলামের কক্ষে এসে এক ব্যক্তি পূর্বাচলে নিজের প্লট থাকার কথা জানিয়ে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন। এর পর পূর্বাচলে প্লট কেনার প্রস্তাব দেন তিনি। পরে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভিজিটিং কার্ড বিতরণ করা ওই ব্যক্তি পূর্বাচলের বাসিন্দা শাহীন মালুম। তিনি রাজউকে ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত।</p> <p>জানা গেছে, শাহীন মালুমের মতো এভাবে প্রায় প্রতিদিনই রাজউকে আসেন পূর্বাচলের বাসিন্দা মারফত, আনোয়ার, আনসার, রমজান, মজিবুর, দেলোয়ার, হাসমতসহ প্রায় ২০ জন। তাঁরা ‘আদি বাসিন্দা প্লট’ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বিরুদ্ধে অ্যাওয়ার্ড ও প্লট নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে রাজউকে।</p>