<p><span style="line-height:1.6em">ধরলা নদীর বাঁধভাঙা ঢলের পানি তেড়ে আসছিল ঘরবাড়িতে। আট বছরের ছেলেকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন গৃহবধূ ফাতেমা। ছেলেকে খাল পার করে দিয়ে নিজে আর পার হতে পারেননি। প্রবল স্রোতে ভেসে যান ফাতেমা। বাঁচার জন্য একটি ছোট শিমুল গাছ ধরেছিলেন; কিন্তু সেটিসহ ভেসে যান প্রবল স্রোতে। তিন দিন পর মঙ্গলবার যখন তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো, তখনো গাছটির ডাল আঁকড়ে ছিল  একটি হাতে। কাপড় পেঁচিয়ে ছিল ডালে। মৃতদেহ বাড়িতে আনার পর ফাতেমার জা শামছুন্নাহার আহাজারি করছিলেন, ‘সাদা পানি মোর বইনোক খাইছে।'</span></p> <p>গত শনিবার রাত আড়াইটার দিকে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ার চরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি ভেঙে যায়। হু হু শব্দে পানি ঢুকতে থাকে লোকালয়ে। ছাট কালুয়া, মেকলি, জয়কুমর ও চতুর্ভুজ মৌজার পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। <span style="line-height:1.6em">নিখোঁজ হয় দুজন। এক কাপড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসে সবাই। এখন তারা আশ্রিত একতা বাজারের কাছে বাঁধের ওপর, ব্রিজে; খোলা আকাশের নিচে।</span></p> <p>কুড়িগ্রাম শহর থেকে কালুয়ার চরের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। পথে ভাঙা সেতু। কলার ভেলায় পার হতে হলো। এভাবে মঙ্গলবার দুপুরে দুর্গতদের দুর্দশা দেখতে দূরে কালুয়ার চরে যেতেই দেখা গেল, মানুষ ছুটছে। লাশ আসছে- এ খবরে সবার গন্তব্য মৃত ফাতেমার স্বামী লোকমানের বাড়ি। তাঁর বাড়ির পাশেই ভেঙে গেছে বাঁধটি। ফাতেমার ভগ্নিপতি জানান, নিখোঁজ হওয়ার পর থেইে মাইকিং করা হচ্ছিল। কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায়নি। সকালে লোকমুখে সংবাদ শুনে ৫০০ টাকায় নৌকা রিজার্ভ করে মেকলি গ্রামে যান। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ফাতেমার মৃতদেহ। ফাতেমার বাড়িই ধরলার আগ্রাসনের মুখে। তাই কবর দেওয়া নিয়ে চিন্তিত স্বজনরা।</p> <p>এদিকে একতা বাজারের ব্রিজ ও বাঁধের ওপর শত শত পরিবার খোলা আকাশের নিচে গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ পলিথিন টানিয়ে, কেউ ভটভটিতে আবার কেউ টিনের চালা করে আশ্রয় নিলেও অনেকেই খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। পানি কমতে থাকায় বাড়ি থেকে ভেজা ধান, চাল, ভুট্টা এনে রোদে শুকাচ্ছে অনেকে। বাঁধের দুই পাশে অসংখ্য বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। কালুয়ার চর ক্লিনিকটি পানির তোড়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে পানিতে। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। পথে পথে ব্রিজ, পাকা রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে আছে।</p> <p>কালুয়ার চর গ্রামের সাহের আলী জানান, বাঁধ ভেঙে তাঁর বাড়িটিই প্রথম ভেসে যায়। কোনোমতে জীবন নিয়ে পালাতে পেরেছেন। তাঁর প্রতিবেশী হামিদের তিনটি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আর ফাতেমা তো হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এখনো রিফাত নামের একটি শিশু নিখোঁজ রয়েছে। বন্যার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বাঁধের ধারে বাসকারী ইউনুছ আলী বলেন, 'এমন বান হইবে ভাবি নাই। পাঁচ মিনিটে বাড়িত গলাপানি উঠছে।'</p> <p>চরজয়কুমরের কলেজছাত্র মোস্তফা জানান, তাঁর দাদু মনির উদ্দিন (৮০) রাতে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সকালে তাঁকে বাঁশগাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। তিনি বাঁশগাছে লটকে ছিলেন। বিধবা কহিনুর ছোট একটি মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় উঠেছেন। মাথার ওপর কোনো আচ্ছাদন নেই। বলেন, 'পলিথিন কিনুম তার টাকা নাই।' মালা বেগম জানান, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে তাঁর দুটি ঘর বিধ্বস্ত হয়। ৩০ মণ ধান ভিজে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কী খাবেন তা নিয়ে যত দুশ্চিন্তা। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে চিড়া, জাকের পার্টির মুড়ি ও আওয়ামী লীগের খিচুড়ি ছাড়া অন্য ত্রাণ পাননি তাঁরা। যদিও রান্না করার সুযোগ না থাকায় প্রতিদিন খাবারের প্রয়োজন। খাবার কিনবে তার সংগতি নেই কর্মহীন দিনমজুর পরিবারগুলোর।</p> <p>নুর আলম ও রবিউল জানান, মরা ছাগল, গরু, হাঁস-মুরগির কারণে বাঁধের দুই পাশের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এখনো কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের কাছে আসেননি বলে অভিযোগ তাঁদের। বৃদ্ধ ইমান আলীর বিপদ তাঁর সাতটি গরু নিয়ে। বাঁধের ওপর গরু রাখলেও খাবারের অভাবে মারা যাওয়ার উপক্রম। খড়ের দাম প্রতি আঁটি পাঁচ টাকা। নিজে খাবেন, নাকি গরুকে খাওয়াবেন। গ্রামের কৃষক মফিজুল হক জানান, তাঁর একটি গরু ৬৬ হাজার টাকা দাম করেছিল পাইকার। এখন ষাট হাজার টাকা দাম করছে। দিনে দিনে দাম কমছে গবাদি পশুর। ঈদে আরো কমবে বলে ধারণা তাঁর।</p> <p>ছিনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বুলু জানান, যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখার উদ্যোগের পাশাপাশি সব বন্যার্তকে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।</p> <p>কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, রোগ-ব্যাধির প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে ওই এলাকায় মেডিক্যাল টিম পাঠানো হবে।</p> <p> </p> <p> </p>