আবদুল্লাহ হিল কাফি, রায়হানা শামস ও মায়সুন ইবনে মনোয়ার
জাপানের একটি বিখ্যাত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো কিউশু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (কিউটেক)। সেখানে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের দুই শিক্ষার্থী। একজনের নাম খলিলুর রহমান, অন্যজন আরিফুল ইসলাম। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আসেন খলিলুর রহমান। তিনি আপন দেশে ফিরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। আরিফুল ইসলাম থেকে যান জাপানেই। তিনি কেআইটিতে ল্যাবরেটরি অব স্পেসক্র্যাফট ইন্টার্যাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে থেকেও এই দুই বন্ধুর যোগাযোগ ও পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা কমেনি। কখনো কোনো অবসরে তাঁরা একে অন্যকে ফোন করেন। নানা বিষয়ে আলাপ হয়। ড. খলিলুর চেয়েছিলেন—ড. আরিফের কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা দেশের কাজে লাগুক। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি নানা বিষয়ে আরো একটু শিক্ষিত করে তোলেন। ফলে ব্র্যাকের একটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে ফোন করে দাওয়াত দিলেন তিনি। ড. আরিফও না করতে পারলেন না। ২০১৩ সালের আগস্টে দেশে এলেন তিনি। সেই সেমিনারেই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরির ভাবনাটি ছড়িয়ে দিলেন তিনি। তিনি বললেন, ‘এই প্রযুক্তি তৈরি তেমন কঠিন কোনো বিষয় নয়, এ জন্য প্রাযুক্তিক জ্ঞান থাকলেই হলো।’ এই কথাটিই ড. খলিলুর রহমানের মনে ধরে গেল। তিনি বন্ধুকে পরে জিজ্ঞাসাও করলেন—‘আমাদের সীমিত জ্ঞান ও সম্পদের মাধ্যমে এমন উন্নত প্রযুক্তিমানে উপগ্রহ বানানো আসলেই সম্ভব?’ বন্ধু উত্তরে জানালেন, অসম্ভব কিছু নয়। তাঁদের মধ্যে উপগ্রহ নিয়ে আরো কথা হলো। বন্ধুর আগ্রহ বিবেচনা করে তাঁকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ দিনের জাপান সফরে নিয়ে গেলেন ড. আরিফুর রহমান। সেবারই প্রথম বিশ্বের অন্যতম সেরা কিউটেকের ল্যাব ঘুরে দেখলেন ড. খলিলুর। আরো অবাক হয়ে গেলেন, যেসব ডিভাইস নিয়ে আমাদের দেশে কাজ করা হয়, সেখানেও একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। আমরা যেভাবে সার্কিট বানাই, তাঁরাও সেভাবেই বানান। রোবট ক্লাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেসব সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করেন, সেখানেও সেগুলো নিয়েই কাজ করা হয়। ফলে তাঁর মনে বল এলো যে আমরাও স্যাটেলাইট বানাতে পারি। এভাবেই ২০১৪ সালের মে মাসে ব্র্যাক ও কিউটেকের মধ্যে শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম বিনিময় চুক্তি হলো। তারই অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিএসসি বিভাগের আবদুল্লাহ হিল কাফি ও মায়সুন ইবনে মনোয়ার অনার্সে ইন্টার্নি করতে কিউটেকে গেলেন। তাঁরা সেখানে মাস ছয়েক কাজ করবেন ও ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে অভিজ্ঞতার সনদ জমা দেবেন। সেখানে কাফি একটি এয়ার টেবিল ও মায়সুন একটি টার্ন টেবিল তৈরি করেছিলেন। সেগুলোই মনে ধরে গিয়েছিল তাঁদের অধ্যাপক মেংগু চোর। তিনি ব্র্যাকে সেই সন্তুষ্টির কথা মেইল করে জানিয়েছিলেনও। তখনই উপগ্রহ বানানোর প্রস্তাব দিলেন প্রফেসর চো। তিনি তাঁর বন্ধুকে প্রস্তাব করেছিলেন—‘আমার দেশের জন্য কিউটেক থেকে একটি উপগ্রহ তৈরি করে দেব।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আলাপের পর সিদ্ধান্ত হলো—এটি তৈরি ও মহাকাশে উেক্ষপণের খরচ দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। সেটির প্রাযুক্তিক জ্ঞান সরবরাহ করবে কিউটেক। ব্র্যাকের চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদের সম্মতিতে কয়েক কোটি টাকার এই চুক্তি হলো। এর পরই শুরু হলো চূড়ান্ত কাজের পালা। তত দিনে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রায়হানা শামস ইসলাম। কিউটেকের মহাকাশ গবেষণা প্রকল্প বার্ডস প্রজেক্টে কাজ করার অনুমতি নিলেন আমাদের তিন শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালের ১৫ জুন এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো।
চাঁদকে বলা হয় প্রাকৃতিক উপগ্রহ। সে পৃথিবীতে আলো দেয়। আর মানুষ মহাকাশে নানা কাজে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়। যেসব উপগ্রহ বিশেষ কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে ‘পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট’ বা ‘কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট’ বলা হয়। এগুলো শিক্ষা গবেষণামূলক কাজে বেশি ব্যবহার করা হয়। ব্র্যাকের ছেলেমেয়েদের বানানো উপগ্রহটিও এই ধরনের। আকারে ছোট বলে একে ন্যানো স্যাটেলাইট বলা হয়। এটির ওজর মাত্র কেজিখানেক, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতায় এটি ১০ সেন্টিমিটার। কিভাবে এটি বানানো হলো, এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলো। তাঁরা জানালেন, প্রথমে আমরা এটির মডেল বানিয়েছি। এরপর আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি অংশের পৃথক মডেল বানাতে হয়েছে। উপগ্রহটি মহাকাশে চলবে কি না সে জন্য অন্তত ১৩টি টেস্ট করা হয়েছে। এতে সহযোগিতা করেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন।
মহাকাশে যাওয়ার সময় আমাদের জাতীয় সংগীত বাজতে বাজতে যাবে। এটি মহাকাশের ৩৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে ঘুরবে। এর ডাউনলোড ক্ষমতা ৯ হাজার ৬০০ বিপিএস আর আপলোড ক্ষমতা এক হাজার ২০০ বিপিএস। এখানে আছে দুটি ক্যামেরা। একটি ফাইভ মেগাপিক্সেলের, অন্যটি দুই মেগা পিক্সেলের। এটির নাম হলো ‘ব্র্যাক অন্বেষা’।
বাংলাদেশের প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইটটি মহাকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলের প্রতিমুহূর্তের ছবি পাঠাবে। সেগুলো পর্যালোচনা করে শহরগুলোতে ভবনের পরিমাণ, ফসলি জমির কমা কিংবা বাড়ার খবরও দেবে এটি। এ ছাড়া আবহাওয়ার পর্যালোচনা পাঠাবে। তাঁরা বললেন, প্রতিটি ফসলের একেকটি রং আছে। যদি ভালোভাবে রং বদলায়, তাহলে জানা যাবে—এবার ভালো ফসল হবে।
‘ব্র্যাক অন্বেষা’র একটি গ্রাউন্ড স্টেশন আছে ব্র্যাকে। সেটি দিয়ে স্যাটেলাইটের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ করা যাবে। এখানে কাজ করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই চার ছাত্র-ছাত্রী—মোজাম্মেল হক, সানন্দ জাগৃতি, বিজয় তালুকদার ও আইনুল হুদা। তাদের এই দলের নাম ‘টি-৩’। তারা স্যাটেলাইটের তথ্য ও ছবিগুলো বিশ্লেষণ করবেন। এ ছাড়া কোনো দুর্যোগ দেখলে সেটি আবহাওয়া অফিসকে জানাবেন।
মন্তব্য
আলোচিত সংবাদ
ব্যাখ্যা ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে কোরআন বোঝা সম্ভব নয়
আমাদের জাহিদ গুগলের ম্যানেজার
বিশ্বের যেসব দেশ ভ্রমণে ভিসা লাগে না...
সিগারেট তৈরির একটি মূল উপাদান ইঁদুরের বিষ্ঠা!
সারাদিন বিছানায় শুয়ে অন্যের রক্ত যোগাড় করেই দিন কাটে মিমের
সীমান্তে সেনা, অস্ত্রের মহড়া মিয়ানমারের