<p style="text-align:justify">পর্বতমালা আর হ্রদের সমাহারে মধ্য-ইউরোপের একটি সুন্দর দেশ সুইজারল্যান্ড। এটি ফেডারেল ধরনের একটি ছোট্ট রাষ্ট্র। দেশটির আয়তন ৪১ হাজার ২২৮ কিলোমিটার। স্থানীয় ভাষায় দেশটি ‘সুয়াতিনি’ নামে পরিচিত। কিংডম অব সুইজারল্যান্ড ১৬৪৮ সালে রোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তবে দেশটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১২৯১ সালে। দেশটির পশ্চিমে ফ্রান্স, উত্তরে জার্মানি, পূর্বে অস্ট্রিয়া ও দক্ষিণে ইতালি অবস্থিত। মাত্র ৮৩ লাখ জনসংখ্যার (২০১৬) এই দেশটি শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন। দেশটির জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই জার্মানির অধিবাসী। এরা জার্মান ভাষায় কথা বলে। ২০ শতাংশ লোকের ভাষা ফ্রান্স, আর ৪ শতাংশ মানুষের ভাষা ইতালি। সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফ্রান্স, জার্মান, ইতালিয়ান ও রোমান।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সুইজারল্যান্ডে ইসলাম</strong></p> <p style="text-align:justify">ইউরোপে, বিশেষ করে স্পেনে ইসলামের আগমন ঘটে ৭১১ সালে। সেনাপতি তারিক ও মুসার নেতৃত্বে মুসলমানরা  স্পেন অধিকার করে। স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে সুইজারল্যান্ডে মুসলিম উপনিবেশ কায়েম হয়। মুসলমানরা প্রায় ৭০০ বছর স্পেন শাসন করে। ৮৮৯ সালে ২০ জন আরব বণিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে স্পেন ত্যাগ করেন। তাঁদের জাহাজটি ঝড়ের কবলে পড়লে তাঁরা কোনোমতে উপকূলে ভিড়েন এবং তাঁরা আলপসের ঘন বনাঞ্চলে আশ্রয় নেন। এরপর তাঁরা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং একটি ক্ষুদ্র এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। বর্তমানে এই এলাকাটিই সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্র বলে পরিচিত। আরব বণিকদের আগমনের ফলে মুসলমানরা এই এলাকায় ইসলামী সমাজ কায়েম করার সুযোগ পায়। তারা তখন আলপস পর্বতমালার বিভিন্ন স্থানে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। এই পর্বতমালার একটি বড় অংশ আরবদের অধিকারে থেকে যায়। একজন ফরাসি ঐতিহাসিক রেনাল্ট তাঁর ‘বাই দ্য ওয়ে’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আরব মুসলমানরা মুসলিম স্পেনের বাইরে উত্তর ফ্রান্স, ইতালি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করত।’</p> <p style="text-align:justify">১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মুসলমান সুইজারল্যান্ডে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক মুসলমান দেশটিতে পাড়ি জমায়। মুসলমানদের মধ্যে কিছু অগ্রসর লোক সুইস মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার করায় স্থানীয় অনেক মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুইডিশ কবি ফ্রিসহফ সোওয়ান। তিনি ‘ডে অ্যান্ড নাইট’ বইয়ের প্রখ্যাত লেখক। ইসলাম গ্রহণের আগে ফ্রিসহফ সোওয়ান আলজেরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময় সোওয়ান সুইজারল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করেন।</p> <p style="text-align:justify">সুইজারল্যান্ডে ইসলাম প্রচারের কাজ এগিয়ে গেলে অনেক সুইস অধিবাসী ইসলাম গ্রহণে এগিয়ে আসেন। ফলে দিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা ছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকেও মুসলমানরা প্রবাসী হিসেবে সুইজারল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। ১৯৫১ (১৩৭১ হিজরি) সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ব্যাপকসংখ্যক মুসলমানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় জেনেভায়। এটি আলপস ও জুরা পর্বতমালাবেষ্টিত একটি আধুনিক শহর। এটি বিশ্ব কূটনীতি ও ব্যাংকিংয়ের জন্য বিখ্যাত। এর জনসংখ্যা এক লাখ ৯৪ হাজার। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সুইজারল্যান্ডে ব্যাপক হারে মুসলিম নাগরিক বৃদ্ধি পায়। ফলে ১৯৮০ সালে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে ছিল ৫৬ হাজার (জনসংখ্যার ০.৯ শতাংশ), তা ১৯৯০ সালে বেড়ে হয় প্রায় ছয় গুণ। বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা চার লাখ। এর মধ্যে ৮৮.৩ শতাংশ প্রবাসী মুসলিম। প্রবাসীদের ৫৬.৪ শতাংশ সাবেক যুগোস্লাভিয়ার নাগরিক (বিশেষ করে বলকান ও কসোভার নাগরিক), ৬ শতাংশ তুরস্ক ও ৩.৪ শতাংশ আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আগত। মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় অধিবাসী। </p> <p style="text-align:justify"><strong>সুইজারল্যান্ডে ইসলামী প্রতিষ্ঠান</strong></p> <p style="text-align:justify">সুইজারল্যান্ডে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় ১৯৬৩ সালে, জুরিখে। এটি বিশ্বের অন্যতম শহর এবং ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সের কেন্দ্রবিন্দু। শহরটির জনসংখ্যা তিন লাখ ৯০ হাজার। এই মসজিদ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্মাণ করে। সুইজারল্যান্ডের অন্যতম শহর জেনেভায় নামাজের ব্যবস্থা হিসেবে একটি ইসলামী সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় সত্তরের দশকে। তবে এটি বেশিদিন টেকেনি। ১৯৭২ সালে (১৩৯২ হিজরি) সুইজারল্যান্ডে মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাত সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি এই সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে, যার মধ্যে জেনেভায় অবস্থিত বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনের একটি বিধিমালা তৈরি করা হয়, যা পরবর্তী সময় সুইস সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিল। এই সংগঠনের কমিটি সুইজারল্যান্ডে মসজিদ ও ইসলামী সেন্টার নির্মাণের অনুমোদনও পেয়েছিল।</p> <p style="text-align:justify">সৌদি আরবের বাদশাহ কিং ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজ আস সৌদ ১৯৭৩ সালে সুইজারল্যান্ড সফর করেন। তিনি ইসলামী সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটি ‘কিং ফয়সাল সেন্টার’ নামে পরিচিত ছিল। এই সেন্টার সুইজারল্যান্ডে কর্মরত বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই ইসলামী সেন্টারের অবস্থান জাতিসংঘের ইউরোপীয় প্রধান কার্যালয়ের কাছাকাছি। সেন্টারের মসজিদটি বেশ বড় এবং এখানে কয়েক শ মুসলমানের একত্রে নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা আছে। সেন্টারে একটি লাইব্রেরি, একটি ইসলামী স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুসলিম ছেলে-মেয়েদের এখানে বিনা খরচে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হয়।</p> <p style="text-align:justify">ইসলামী সেন্টারের নানা তৎপরতার মধ্যে অন্যতম হলো ইসলামী পত্রিকা প্রকাশ। এই পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধান ও ইসলামবিরোধী নানা রকম অপপ্রচার মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়। পত্রিকার মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে (১৩৯৮ হিজরি) জেনেভায় ইসলামী সেন্টারটি নির্মাণ করা হয়। সৌদি আরবের বাদশাহ কিং খালিদ ইবনে আবদুল আজিজ আল সৌদ এই সেন্টারের শুভ উদ্বোধন করেন। সেন্টারটি নির্মাণ করতে খরচ হয় ১২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। সৌদি আরব ছাড়া দেশটির মুসলমানরাও সেন্টারের কাজে অংশগ্রহণ করে। ইসলামী সেন্টারের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডে ইসলামের কাজ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডে ১৯৮০ সালের দিকে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। জুরিখে ১৯৮৯ সালে ‘জ্যামেইনশাফট ইসলামশার অর্গানাইজেশন দার সেচউইঝ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে অনেক ইসলামী সংগঠন সুইজারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘ভেরেইনিগাংগ ইসলামশার অর্গানাইজেশন জুরিখ (১৯৯৫), বাসলার মুসলিম কমিশন সেচউইঝ, ব্রাসেল (১৯৯৭), কো-অর্ডিনেশন ইসলামশার অর্গানাইজেশন সেচউইঝ (২০০০) ইত্যাদি।</p> <p style="text-align:justify"><strong>উপসংহার</strong></p> <p style="text-align:justify">সুইজারল্যান্ডে ইসলামের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা কাজের প্রয়োজনে, পড়ালেখার জন্য অথবা গবেষণার কাজে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটি মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। তা ছাড়া বর্তমান পতনশীল ইউরোপের বেলাভূমিতে যে হতাশা ও ক্ষয়ের সূচনা হয়েছে, তার কারণেও মানুষ ইসলামের কালজয়ী আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ লাখে। আমরা প্রত্যাশা করি, একদিন সুইজারল্যান্ডের মুসলমানরা শক্ত ভিত্তি রচনা করবে এবং দেশটির উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>লেখক :</strong> শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাবেক সিনিয়র ব্যাংকার </p>