<p>ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামই সর্বপ্রথম মূর্খতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বরং সব অধিকার ও কর্তব্য ছাপিয়ে ইসলাম শিক্ষাকে সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বমানবতার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত ইসলামের প্রথম বাণী এমন: ‘পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো, তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত; যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান দান করেছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)</p> <p>পড়ার নির্দেশনা নিয়ে প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়। এরপর সুরা মুদ্দাসসির ও সুরা আদ-দোহা অবতীর্ণ হলে মহানবী (সা.) পুরোদমে তাওহীদ ও রিসালতের প্রচার শুরু করেন। সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সহধর্মিনী হজরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.) ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। [ইবনে ইসহাক, সীরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.), বাতায়ন প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১৩৭]</p> <p>এরপর নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দের সতর্ক করে দাও।’ (সুরা শুআরা, আয়াত : ২১৪)<br /> এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মহানবী (সা.) তাঁর নিকটতম ও বিশ্বাসযোগ্য লোকদের কাছে নবুয়তের কথা প্রকাশ করতে শুরু করেন। তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে প্রথমবারেই ‘লাব্বাইক’ বলেছেন কয়েকজন আপনজন।</p> <p>হজরত আলী (রা.), হজরত আবু বকর (রা.) জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.), উসমান ইবনে আফফান (রা.), জুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) ও তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) সহ মোট আট জন। পরে আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.), আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ ও আরকাম ইবনে আবুল আরকাম (রা.) সহ প্রথম তিন মাসে মোট ৪০ জন মতান্তরে ৪১ জন ইসলাম গ্রহণ করেন। (ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পৃষ্ঠা ৫৯)।</p> <p>এর পর মাত্র তিন বছর সময়ে এক শ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে  বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।</p> <p>নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে ১১ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হজরত উসমান (রা.)ও ছিলেন। এটাই ইসলামের প্রথম হিজরত। তাঁদের অনেকে মক্কায় পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর শুনে ফেরত এসেছিলেন। পরে যখন দেখা গেল খবরটি অসত্য, তখন নবুয়তের সপ্তম বছর জাফর (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৮৬ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারী সাহাবা দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরত। পরে তাঁরা সপ্তম হিজরিতে সেখান থেকে মদিনায় হাজির হয়েছিলেন।</p> <p>ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, আবিসিনিয়ায় ইসলামের প্রথম হিজরতকারীদের সংখ্যা ছিল ৮৩ জন। আর মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।</p> <p>এই নওমুসলিমরা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁদের জন্য ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানার ও শেখার ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী দলকে নিয়ে ‘দারুল আরকামে’ সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। এটি ছিল নওমুসলিম আরকাম ইবনে আবুল আরকামের বাড়ি। এ বাড়িতে মহানবী (সা.) দাওয়াতের কাজ করতেন। পাশাপাশি সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের মধ্যে কোরআন, নামাজ ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র।</p> <p>তবে আরো একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর গৃহে ‘দারুল আরকামের’ আগে ইসলামের প্রথম উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করেছিলেন। সেখানে নামাজের প্রশিক্ষণ হতো, কোরআনের তেলাওয়াত হতো। (ড. আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব, ইফা, পৃষ্ঠা ৪৩)</p> <p>পরে সেটি মসজিদে আবু বকর (রা.)-এ রূপ নেয়। সহিহ বুখারি শরিফের কিতাবুল কাফালায় বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, মসজিদে আবু বকরে কোনো মুয়াল্লিম বা শিক্ষক ছিল না। হজরত আবু বকর (রা.) নিজেই সেখানে তালিমের কাজ আঞ্জাম দিতেন। এখানে অমুসলিম ছেলে-মেয়েরাও কোরআনের তেলাওয়াত শুনত।</p> <p>ইবনে হিশাম হজরত ওমর (রা.)-কে উদ্ধৃত করে বলেন, খাত্তাবের কন্যা ও ওমর (রা.)-এর বোন ফাতেমা ও তাঁর স্বামী সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নিজ গৃহে একটি ইসলামী উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ইবনে আবত (রা.) নামের একজন সাহাবি নওমুসলিমদের কোরআন শিক্ষা দিতেন।</p> <p>এ আলোচনা থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.)-এর মক্কার জীবনে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় ছিল ব্যক্তিগত। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। আর যারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিতেন, তিনি তাঁদের অনানুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। দ্বিতীয় পর্যায় ছিল গৃহে অথবা আঙ্গিনায় মসজিদ বা মক্তব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেমন-আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর বোন ফাতেমা (রা.)-এর গৃহে প্রতিষ্ঠিত মক্তব। তৃতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাফা-মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে রাসুলুল্লাহ (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে ‘দারুল আরকামে’।</p> <p>মক্কাকেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার এই ধারা কালক্রমে মদিনায় স্থানান্তরিত হয়। হিজরতের আগেই এই স্রোত মদিনার অলিগলিতে প্রবাহিত হয়।</p> <p>লেখক : ইসলামী গবেষক</p>